কী করতে চাচ্ছেন নেতানিয়াহু?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৭ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২৪
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু/ ছবি: এএফপি

লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযানের দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষের পথে এবং একই সাথে ইসরায়েল যুদ্ধ জড়ানোরও দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করলো। বৃহস্পতিবার বৈরুতের বিমান হামলার পর যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জোরালো হচ্ছে। দক্ষিণ লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর দ্বিতীয় দিনের মতো হামলা করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। খবর বিবিসির।

সংঘাত অবসানের আহ্বান সত্ত্বেও নতুন করে হামলা শুরু হয়েছে জাবালিয়ায়। ইসরায়েলের সহযোগীরা দেশটিকে গত সপ্তাহের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও ধৈর্য ধারণের আহবান জানিয়েছে। যদিও সব চাপ উপেক্ষা করে ইসরায়েল তার নিজের পথেই চলছে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে দামেস্ক থেকে রাতের একটি ফ্লাইটে বাগদাদে এসেছিলেন ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। তিনি ইরানের এলিট বাহিনী কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন। এটি মূলত ইরানের বিপ্লবী গার্ডের গোপন ইউনিট।

এই গ্রুপটির নামের অর্থ জেরুজালেম এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসরায়েল। ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও অন্যত্র অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ ও সরাসরি ছায়া বাহিনী হিসেবে কাজ করে তারা। ওই সময় সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পর ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মানুষ।

সোলাইমানির গাড়ি বহর বিমানবন্দর ছাড়া মাত্রই ড্রোন থেকে ছোড়া মিসাইলে তিনি নিহত হন। যদিও ইসরায়েল তার প্রতিপক্ষের অবস্থান চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে, তারপরেও ড্রোনটি ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের। ওই হত্যাকাণ্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নির্দেশে হয়নি।

পরে এক বক্তৃতায় সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি কখনোই ভুলবেন না যে নেতানিয়াহু তাদের হতাশ করেছিলেন। আরেকটি ইন্টারভিউতে তিনি বলেছেন যে, ওই ঘটনায় তিনি ইসরায়েলের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিলেন এবং অভিযোগ করেছিলেন যে নেতানিয়াহু চাইছিলেন যে ‘আমেরিকা তার শেষ সৈন্য পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই করুক’।

নেতানিয়াহু ওই হত্যাকাণ্ডের প্রশংসা করেছিলেন। তবে ওই সময় এটা মনে করা হতো যে তার উদ্বেগ ছিলো এই যে ইসরায়েল সরাসরি জড়িত হলে এটা সরাসরি ইরান কিংবা লেবানন ও ফিলিস্তিন থেকে ইসরায়েলে বড় ধরণের হামলার কারণ হতে পারে।

ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে ছায়া যুদ্ধে জড়িত ছিল কিন্তু উভয়পক্ষই সতর্ক ছিল যেন তাদের লড়াই একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। বড় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার উস্কানি হতে পারে-এমন ভয় থেকেই এটা হতো।

চার বছর পর চলতি বছর এপ্রিলে নেতানিয়াহু দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক কম্পাউণ্ডে বোমা হামলার নির্দেশ দেন। সেখানে নিহতদের মধ্যে দুজন ইরানি জেনারেলও ছিলেন।

এরপর জুলাইয়ে বৈরুতে বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুকর হত্যার অনুমোদন দেন তিনি। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাতে হতভম্ব হয়েছিলেন বলে বব উডওয়ার্ডের নতুন এক বইয়ে দাবি করা হয়েছে। এখানে হতভম্ব হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সংঘাত বাড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন যা হোয়াইট হাউজ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিল।

ইসরায়েল সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যে ধারণা তৈরি হচ্ছে তা হলো ‘তুমি একটা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র, একজন দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়’। একই প্রধানমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট চিহ্নিত করলেন ‘অত্যন্ত সতর্ক’ হিসেবে আর তার উত্তরসূরি চিহ্নিত করলেন আগ্রাসী হিসেবে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন এবং একটি রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিপর্যয়কর দিন। এ দুটি বিষয়ই ইসরায়েলকে চলমান যুদ্ধে জড়িত হতে সহায়তা করে।

ইসরায়েলে হামাসের হামলার মাত্রা ও ব্যাপকতা ইসরায়েলি সমাজ ও এর নিরাপত্তাবোধের ওপর প্রভাব ফেলেছে, যে কারণে এবারের যুদ্ধ সাম্প্রতিক সব সংঘাতের চেয়ে আলাদা।

যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিচ্ছে ইসরায়েলকে। আবার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু ও গাজার দুর্ভোগ তাদের জন্য অস্বস্তির ও রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর।

এপ্রিলে ইসরায়েলে ইরানের হামলার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানও সক্রিয় ছিল। এটি একটি পরিষ্কার প্রমাণ যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিষয়ে তার সবচেয়ে বড় সহযোগী কতটা ভূমিকা রাখে।

চলতি গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইসরায়েলের দীর্ঘসময়ের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ২০ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছেন যে, উপেক্ষা না করলেও, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলানো যায়।

নেতানিয়াহু জানেন যে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে তাদের বর্তমান নির্বাচনের বছরে তাকে তার পথ থেকে সরাতে চাপ দিবে না এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে তিনি আমেরিকার শত্রুর বিরুদ্ধেও লড়ছেন।

এটা মনে করা ঠিক হবে না যে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের রাজনৈতিক মূলধারার বাইরে গিয়ে কাজ করছেন। সেজন্য হিজবুল্লাহর ওপর শক্ত আঘাত হানার চাপ বাড়তে পারে, এমনকি ইরানের বিরুদ্ধেও।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স যখন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল তখন ইসরায়েলের বিরোধ ও প্রধান বাম ও ডান ধারা থেকে ২১ দিনের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরোধিতা সমালোচনা আসলো। ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এর কারণ শুধু এটা নয় যে তারা আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায় সক্ষম বরং ৭ অক্টোবরের পর নিজের হুমকিগুলোর প্রতি সহনশীলতার নীতি পাল্টে গেছে।

হিজবুল্লাহ দীর্ঘকাল ধরেই ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের গালিলিতে আগ্রাসন চালাতে চাইছে। এখন ইসরায়েলের মানুষের ঘরে বন্দুকধারীর হামলার অভিজ্ঞতা হলো। সে কারণে তারা মনে করলে এই হুমকি উপড়ে ফেলতে হবে।

ঝুঁকির বিষয়ে ইসরায়েলের ধারণাও পাল্টে গেছে। ওই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সামরিক সীমারেখা হারিয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যা সর্বাত্মক সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে তেহরান, বৈরুত, তেল আবিব ও জেরুজালে, বৃষ্টির মতো বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।

ইসরায়েল হামাস প্রধানকে হত্যা করেছে যখন তিনি তেহরানে ইরানের অতিথি ছিলেন। তারা হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহসহ পুরো নেতৃত্বকে ধ্বংস করেছে। সিরিয়ায় কূটনৈতিক ভবনে দুজন ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে।

হিজবুল্লাহ নয় হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন ছুড়েছে ইসরায়েলের শহরগুলো লক্ষ্য করে। তেল আবিবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইরান সমর্থিত হুতিরাও বড় ধরণের হামলা চালিয়েছে। ইরানও গত ছয় মাসে দুবার হামলা করেছে। এসব হামলায় পাঁচশর বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালিয়েছে। এর কোনো একটিই হয়তো ওই অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে এবং সত্যি হলো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও এসব বিষয়ে কোন ঝুঁকি না নিয়েই তার পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে মনে হচ্ছে।

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।