শ্রীলঙ্কা

দিশানায়েকে প্রেসিডেন্ট হওয়াটা কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্বভার নিয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে /ছবি: সংগৃহীত

দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হওয়াটা কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ? চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে যখন ভারত সফরে গিয়েছিলেন, সেই সময় কেউ অনুমান করতে পারেনি যে মাত্র সাত মাসের মধ্যে বামপন্থি এই নেতা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।

এখন প্রশ্ন হলো বামপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ায় ভারতের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে?

শ্রীলঙ্কার বিদেশ নীতিতে ভারতের অবস্থান

রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরে, অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই তালিকায় আছে দেশের অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি ও জাতিগত উত্তেজনার মতো অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার বিদেশ নীতিকে তিনি কোন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন ও তার নিরিখে ভারতের সঙ্গে সে দেশের সম্পর্কই বা কোন পথে যাবে সেটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

মতাদর্শের দিক থেকে ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি ডানপন্থি। অন্যদিকে, অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে বামপন্থি আদর্শের নেতা। সাধারণত বামপন্থি সরকারকে মতাদর্শগতভাবে চীন ঘনিষ্ঠ হিসেবে ধরা হয়। এই পরিস্থিতিতে দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়াবে?

অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ দিল্লির ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্টাডিজ অ্যান্ড ফরেন পলিসি’ বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান। তার মতে দিশানায়েকে ও জেভিপি (জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা) অতীতে কিছুটা ‘ভারতবিরোধী’ ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই নীতিতে পরিবর্তন দেখা গেছে।

অধ্যাপক পন্থ বলেন, ‘তার দল জেভিপি ঐতিহ্যগতভাবে ভারতবিরোধী। শুরু থেকেই তারা সে দেশে ভারতের প্রভাবের বিরুদ্ধে। ইতিহাস ঘাটলে আপনি দেখতে পাবেন ওরা বহুবার ভারতের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদ করেছে।’

অধ্যাপক পন্থ বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় ভারতের প্রভাব কমানোর বিষয়টা বরাবরই দিশানায়েকের কাছে একটা বড় এজেন্ডা। তবে, আমার মনে হয় সাম্প্রতিক বছরে দিশানায়েকের বক্তব্য কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ এবং চিন্তাশীল হয়েছে। তিনি সুশাসন, ভারসাম্য ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন।”

‘এই বিষয়টা তার সরকারের নজরে থাকবে বলে আমার মনে হয়। বিশেষত আইএমএফের (ইন্টারন্যাশানাল মানিটারি ফান্ড বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)-এর প্যাকেজের পরবর্তী প্রভাব ও সমাজে তার ফল সে কথা কথা মাথায় রেখে। এসব ইস্যুই কিন্তু নির্বাচনে তার জয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

অধ্যাপক পন্থ জানিয়েছেন, ২০২২ সালে মহিন্দা রাজাপাকসার সরকার যেভাবে পড়ে গিয়েছিল এবং রনিল বিক্রমাসিংহে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই সময় শ্রীলঙ্কাকে যেভাবে সাহায্য করেছিল ভারত সেকথা মাথায় রেখেই নতুন সরকারকে কাজ করতে হবে।

চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজের অধ্যাপক গ্ল্যাডসন জেভিয়ার বলেন, ভারতের করা আর্থিক সহায়তার কথা নতুন প্রেসিডেন্ট স্মরণে রাখবেন। কিছু ভারতীয় প্রজেক্টের সমালোচনা করেছেন তিনি (অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে)। কিন্তু তিনি কখনো চীনের সমালোচনা করেননি। তাই ধরে নেওয়া যায় যে তার মধ্যে এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব রয়েছে।

‘তবে শ্রীলঙ্কা এখনো অর্থনৈতিক সঙ্কটে রয়েছে। তাদের আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন কিন্তু এখনও অব্যাহত থাকবে। যখন শ্রীলঙ্কায় গভীর অর্থনৈতিক সংকট দেখা গিয়েছিল তখন ভারত তৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। আমি মনে করি, নতুন প্রেসিডেন্ট এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন। আমার মনে হয় না, তিনি ভারতকে বের করে দিয়ে ওই দেশেকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলবেন।’

জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহিলন কাদিরগামার অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার মতে, এই মুহূর্তে জেভিপি কোনো দেশের সঙ্গে খুব নৈকট্য যেমন রাখবে না, তেমনই খুব দূরত্বও তৈরি করবে না।

বিবিসি তামিল সার্ভিসের সংবাদদাতা মুরলীধরন কাশী বিশ্বনাথনের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি বলছেন, বিষয়টা হলো জনতা বিমুক্তি পেরামুনার কিন্তু সেই পুরনো জেভিপি নেই। এটা একটা মধ্যপন্থি দলে পরিণত হয়েছে। তবে রনিল বিক্রমাসিংহের মতো তিনি ভারতের পক্ষে অতটা অনুকূল হবেন কি না তা বলা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, কোনো দেশের সঙ্গে তিনি খুব ঘনিষ্ঠ বা বৈরী হবেন না। তিনি বুঝবেন এখন কঠোর অবস্থান নেওয়ার সময় নয়।

ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য

ভারত ও চীন দুই দেশই কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে যুঝতে থাকা শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করেছে দুই দেশই।

এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থান। বাণিজ্য ছাড়াও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এখন এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার ভারত ও চীনের সঙ্গে কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখবে?

এর উত্তরে অধ্যাপক পন্থ বলছেন, রাজাপাকসের সরকার চীনের প্রতি খুব ঝুঁকে ছিল এবং শ্রীলঙ্কাকে তার ফলও ভোগ করতে হয়েছিল।চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় চীনকে কোথাও সমর্থন করতে দেখা যায়নি। কিন্তু ভারত সহায়তা করেছিল। সুতরাং আমি মনে করি এটা একদিক থেকে একটা মানদণ্ড হয়ে উঠেছে।

‘সবাই ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়, তারাও তাই করবে। কিন্তু কোনও একটা দেশের প্রতি কি তারা বেশি ঝুঁকবে? এটা একমাত্র সে দেশের ভবিষ্যৎ নীতিমালা থেকেই জানা সম্ভব।’

অধ্যাপক পন্থ বলছেন, আপনি যদি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে থাকেন, তাহলে ভারত ও চীন দুটোই এমন দেশ, যাদের উপেক্ষা করা সম্ভব না। একই সঙ্গে ভারতকে এখন আগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও বিবেচনা করা যাবে না যেমনটা তাদের দল দেখতো। ভারত এখন সক্ষম, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান অনুসারে শীঘ্রই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলেছে। তাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কিন্তু এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এগিয়ে যেতে হবে।

অধ্যাপক পন্থ ও অধ্যাপক জেভিয়ার দুজনেই অনুরা কুমার দিসানায়েকের সাম্প্রতিক ভারত সফরের কথাও উল্লেখ করেছেন।

অধ্যাপক পন্থ বলছেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুরা কুমারা দিসানায়েকে যখন ভারতে এসেছিলেন, সেই সময় আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তিনি। এই বিষয়ে ভারতের ‘সংবেদনশীলতার’ কথা মাথায় রাখা উচিত বলেও জানিয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয় হলো তারা কীভাবে এই (ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কে সমতা বজায় রাখা) বিষয়টাকে বাস্তবায়ন করে। কারণ দিনের শেষে দুই দেশের সঙ্গেই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে তাদের।

অধ্যাপক জেভিয়ার বলেছেন, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুরা কুমারা দিসানায়েকের সঙ্গে ভারতের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল এবং তাকে কিন্তু একেবারে উপেক্ষা করা হয়নি। এই প্রথমবার জেভিপির সংস্পর্শে এসেছিল ভারতীয় পক্ষ।

এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রফেসর পন্থ মালদ্বীপের উদাহরণ টেনে এনেছেন। তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয় বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে বিষয়টা পুরোপুরি বদলে যায়।

‘আমার মনে হয় এখানেও আমরা একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাব। আমার মনে হয় না, আজকের পরিস্থিতিতে আপনি ভারতকে রাগিয়ে শ্রীলঙ্কায় কাজ করতে পারবেন।’

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ তার নির্বাচনি প্রচারের সময় ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়েছিলেন। মুইজুকে চীনপন্থি নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতির ইঙ্গিত মিলেছে।

কয়েকদিন আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের প্রধান মুখপাত্র হিনা ওয়ালিদ জানিয়েছিলেন যে প্রেসিডেন্ট মুইজ শীঘ্রই ভারত সফরে আসবেন।

বায়ু শক্তি প্রকল্পের বিরোধিতা

তবে নির্বাচনের আগে দিসানায়েকে যেভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ী আদানি গোষ্ঠী পরিচালিত বায়ু শক্তি প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ স্মরণে রেখে তার দলকে ‘ভারত বিরোধী’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটা রাজনৈতিক বিতর্কের সময়, মি. দিসানায়েকে আদানি গোষ্ঠীর বায়ু শক্তি প্রকল্পকে বাতিল করার অঙ্গীকার করেছিলেন দিয়েছিলেন। এই প্রকল্প ‘শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্বের ক্ষয়’ বলেও সেই সময়ে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহিলন কাদিরগামার বিবিসির তামিল প্রতিনিধি মুরলীধরন কাশী বিশ্বনাথনকে জানিয়েছেন, শুধুমাত্রে এই একটা ইস্যুর উপর ভিত্তিতে সম্পর্কের বিষয়ে কোনও উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, একটা ভারতীয় প্রকল্প বলেই যে আদানির বায়ু প্রকল্প নিয়ে বিরোধিতার, বিষয়টা তেমন নয়। শুধু জেভিপি নয়, অন্যরাও এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে। পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক কারণে এই পরিকল্পনা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।