ভারতীয়রা বিয়েতে এত বেশি খরচ করে কেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫৪ পিএম, ১৫ জুলাই ২০২৪
অনন্ত আম্বানি এবং রাধিকা মার্চেন্ট গত ১২ জুলাই বিয়ে করেছেন। ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলের জমকালো বিয়ে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে তুমুল আলোচনা চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এই বিয়ে সংক্রান্ত নানা তথ্যে সয়লাব। বিয়েতে আসা বিভিন্ন দেশের তারকা, তাদের পোশাক ও স্টাইলিশ লুক নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।

বলিউড তারকা, ভারতীয় ক্রিকেট দলের বড় তারকা, শীর্ষ শিল্পপতি, বহু দেশের বিশিষ্ট নেতা এবং পপ আইকন জাস্টিন বিবারের মতো সেলিব্রিটিরা এই বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।

কয়েক মাস ধরে অনুষ্ঠান

অনন্ত আম্বানি এবং রাধিকা মার্চেন্ট গত ১২ জুলাই বিয়ে করেছেন। তবে বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা কয়েক মাস ধরেই চলছে।

বিয়েতে কত খরচ হচ্ছে তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

আরও পড়ুন>>

বিয়েতে বিপুল অংকের টাকা খরচ করা ভারতের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে। এটি প্রায় প্রতিটি পরিবারের সাধারণ গল্প।

ভারতীয় পরিবারগুলো বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সমাজের কাছে তাদের সম্পদ, মর্যাদা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা দেখানোর চেষ্টা করে। এমনকি, লোক দেখানোর জন্য এমন অনুষ্ঠান করতে যে মোটা টাকার প্রয়োজন, সেটি জোগাড় করতে অনেক সময় পরিবারগুলো ঋণ নিয়ে থাকে।

হিন্দু পারিবারিক বিয়েতে সঙ্গীত এবং গায়ে হলুদের মতো আচারগুলো বেশ জাকজমকভাবে পালন করা হয়। মুসলিম পরিবারের বিয়েতে ‘মেহেন্দি’, ‘নিকাহ’ এবং ‘ওয়ালিমা’র মতো আচার-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এছাড়া, খ্রিস্টানদের বিয়েতে বাগদান, বিয়ের অনুষ্ঠান এবং অভ্যর্থনা অন্তর্ভুক্ত থাকে।

অর্থাৎ, শুধু আম্বানি পরিবারের বিয়েই নয়, ভারতীয় সমাজে প্রতিটি বিয়েকেই গর্বের প্রতীক বলে মনে করা হয়। প্রতিটি পরিবার তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে, চেষ্টা করে অনুষ্ঠানটিকে জমকালো এবং স্মরণীয় করে তোলার।

marriage

বিলিয়ন ডলারের বিয়ের বাজার

ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজার সংস্থা জেফরিজ ভারতীয়দের বিয়েতে এমন বিপুল অংকের টাকা খরচের তথ্য দিয়েছে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বিয়ের অনুষ্ঠানের বাজার প্রায় ১০ দশমিক ৭ লাখ কোটি রুপির।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ভারতীয়রা শিক্ষার পেছনে যতটা না ব্যয় করে, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ব্যয় করে বিয়েতে। খাদ্য ও মুদি বাজারের পর এটি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার।

আরও পড়ুন>>

তবে, শুধু ভারতীয়রাই যে বিয়েতে খরচ করেন তা নয়। অন্যান্য দেশেও একই প্রবণতা রয়েছে। ভারতে বিয়ের বাজার যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ (৫৮ লাখ কোটি)। যদিও এটি চীনের বাজারের চেয়ে ছোট (১৪ দশমিক ১ লাখ কোটি)।

বিয়ের অনুষ্ঠানের সংখ্যার দিকে তাকালে, ভারতে প্রতি বছর ৮০ লাখ থেকে এক কোটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। চীনে এই সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ লাখ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ থেকে ২৫ লাখ।

অর্থাৎ, প্রতিটি বিয়ের খরচ আলাদাভাবে হিসেব করলে দেখা যায়, চীনা ও আমেরিকান পরিবার ভারতীয়দের চেয়ে বেশি খরচ করে। কিন্তু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতীয় বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় পরিবারের ওপর আর্থিক বোঝা অনেক বেশি।

জেফরিজের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বিয়েতে গড়ে সাড়ে ১২ লাখ রুপি খরচ হয়। আড়ম্বরপূর্ণ বিয়েতে গড়ে খরচ হয় ২০ থেকে ৩০ লাখ রুপি।

কিন্তু একেকটি বিয়েতে গড় খরচ, অর্থাৎ সাড়ে ১২ লাখ রুপি ভারতের মাথাপিছু আয়ের (২ দশমিক ৪ লাখ রুপি) প্রায় পাঁচগুণ আর ভারতীয় পরিবারের গড় বার্ষিক আয়ের (চার লাখ রুপি) তিন গুণেরও বেশি।

মজার বিষয় হলো, এই খরচ প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত ভারতে শিক্ষার গড় খরচের দ্বিগুণ। যুক্তরাষ্ট্রে বিয়েতে যে খরচ হয়, তা সেখানকার শিক্ষার খরচের প্রায় অর্ধেক।

এই পরিসংখ্যানগুলো বিশ্লেষণ একটি বিষয় নিশ্চিত, এ ধরনের জমকালো বিয়ে ভারতের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর আর্থিক বোঝা তৈরি করে।

marriage india

বিলাসবহুল অনুষ্ঠানের প্রতি আকর্ষণ

চেন্নাইয়ের বাসিন্দা দীনেশ তার বিয়েতে চার-পাঁচ বছর ধরে সঞ্চয় করা অর্থের প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ করেছেন। তিনি পেশায় ইভেন্ট প্ল্যানার অর্থাৎ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনে কাজ করেন। দীনেশ প্রায় ৩০ লাখ রুপি গহনা, বিয়ের হল, মঞ্চ এবং সাজসজ্জার পেছনে ব্যয় করেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী বিয়ের আগে কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। আমরা বাগদান, বিয়ে, বিবাহোত্তর অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান সবকিছুই দারুণ জমকালো ও চোখ ধাঁধানোভাবে করেছি।

শুধু ফটোশুটের জন্যই দীনেশ খরচ করেছেন দেড় লাখ রুপি। গহনার জন্য আরও বেশি অর্থ খরচ করেছেন।

আরও পড়ুন>>

মূলত গহনার ব্যয়ই পুরো বিয়ের বাজেটকে প্রভাবিত করে। জেফরিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় ২ দশমিক ৯ থেকে ৩ দশমিক ৩ লাখ কোটি রুপি খরচ হয় শুধু গহনার পেছনে।

গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়েতে সোনাকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বিলাসবহুল বিয়েতে একই গুরুত্ব দেওয়া হয় হীরাকে।

সোনার গহনা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় বিয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কনের পরিবার যৌতুক হিসেবে বরের পরিবারকে স্বর্ণালংকার দিয়ে আসছে এবং এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। এমনকি বাবা-মা ঋণ নিয়ে মেয়েদের জন্য গহনা কেনেন সেখানে।

গহনার পরে খাবার হলো বিয়ের অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বড় খরচের খাত। সাধারণত ১ দশমিক ৯ থেকে ২ দশমিক ১ লাখ কোটি রুপি অতিথিদের খাওয়ানোর পেছনে ব্যয় করা হয়।

এছাড়া পোশাক, মেকআপ, ফটোগ্রাফিসহ অন্যান্য বিষয়ে আলাদা খরচ রয়েছে।

সেলিব্রেটিদের প্রভাব

ভারতে বিয়ের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব থাকার কারণে অন্য দেশগুলো তাদের বিয়ে সংক্রান্ত এই বিশাল বাজার ধরার চেষ্টা করছে। তবে গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় পরিবারগুলোকে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিবর্তে ঘরোয়া স্থান বেছে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

ভারতের জয়পুর এবং উদয়পুরের প্রাসাদ ও হোটেলে, সেই সঙ্গে গোয়ার সমুদ্র সৈকতে দেশটির ধনী ব্যক্তি, বিশেষত বলিউডের সেলিব্রেটিদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

ইভেন্ট আয়োজক ‘ম্যারেজ কালার’র ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর প্রদীপ চন্দর জানান, তামিলনাড়ু ও কেরালার মতো দক্ষিণ ভারতের রাজ্যে সেলিব্রেটিদের বিয়ের অনুষ্ঠান করার প্রবণতা বেড়েছে।

তিনি বলেন, আম্বানি পরিবার খালি জায়গায় গ্র্যান্ড ডিভাইন সেট তৈরি করে প্রি-ওয়েডিং ফাংশন আয়োজন করে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। একই সময়, বলিউড সেলিব্রেটিরা এখন বিভিন্ন হিট সিনেমায় দেখানো সুন্দর সুন্দর থিমে বিয়ে করতে আগ্রহী। অনেকেই সমুদ্র সৈকতে বিয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

তবে এর মধ্যেও ভারতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ সাদাসিধে বিয়ে করে খরচ কমাতে আগ্রহী। তামিলনাড়ুর মাদুরাই জেলার মনোজ তাদের একজন।

তিনি বলেন, আমি প্রেম করে বিয়ে করেছি। কিছু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি করলাম। ঋণ নেয়া এবং বিয়ের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করার পরিবর্তে বাড়ির জন্য গুরুত্বপূর্ণ গৃহস্থালি সামগ্রী কেনায় একই অর্থ ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা।

সুত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।