চিকিৎসক থেকে ইরানের প্রেসিডেন্ট, কে এই পেজেশকিয়ান?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ০৭ জুলাই ২০২৪
ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ছবি: এএফপি

ইরানে সদ্য নির্বাচিত সংস্কারপন্থি প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অনেকের মনেই এখন প্রশ্ন তিনি কি দেশটির দীর্ঘদিনের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবেন? স্থানীয় সময় শুক্রবার (৫ জুলাই) দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের ফলাফল ঘোষণা হয় শনিবার (৬ জুলাই)।

দ্বিতীয় দফার ভোটে কট্টরপন্থি সাঈদ জালিলিকে পরাজিত করে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মাসুদ পেজেশকিয়ান। নব নির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট স্বল্পপরিচিত মধ্যপন্থি রাজনীতিবিদ। তিনি হৃদরোগের চিকিৎসক থেকে দেশটির ১৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, পেজেশকিয়ানকে ভোট দেওয়া অধিকাংশ মানুষই শহুরে মধ্যবিত্ত এবং তরুণ বলে মনে করা হচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার কারণে নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অনেকেই বলছেন, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে পেজেশকিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্য রয়েছে। দেশটিতে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার কারণে রাষ্ট্রীয় নীতি, পরমাণু কর্মসূচি বা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কে পেজেশকিয়ান কতটা পরিবর্তন আনতে পারবেন সেটা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে।

ইব্রাহিম রাইসির চেয়ে নীতিগত অবস্থানে ভিন্নতা থাকলেও ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টকে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশ স্বাগত জানাবে কি না এমন প্রশ্নও রয়েছে। তবে পেজেশকিয়ান নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় এরই মধ্যে শুভেচ্ছা জানিয়েছে ভারত, চীন ও রাশিয়ার নেতারা।

শুক্রবার ভোট গণনা করার পরই পেজেশকিয়ানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তিনি পেয়েছেন ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট। অপরদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জালিলি পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট।

মাসুদ পেজেশকিয়ান হৃদরোগ বিষয়ক সার্জন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহর থেকে ইরানের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। তিনি সংসদে ডেপুটি স্পিকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইরানের মাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন মাসুদ পেজেশকিয়ান। ৬৯ বছর বয়সী পেজেশকিয়ান ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় তাবরিজ অঞ্চল থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। দেশটির ১০ম জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালনেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

১৯৮০ সালের ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধের সময় মাসুদ পেজেশকিয়ানকে সম্মুখ সারির চিকিৎসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

নির্বাচনের আগে ইরানের প্রধান সংস্কারপন্থি জোটের সমর্থন পাওয়ার পাশাপাশি সাবেক দুই সংস্কারপন্থি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও হাসান রুহানিরও সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।

২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নিবন্ধন করলেও পেজেশকিয়ান পরে তা প্রত্যাহার করে নেন। এর আগে ১৯৯৪ সালে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি তার স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তানকে হারান। পরবর্তীতে তিনি তার কখনো বিয়ে করেননি। বর্তমানে দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়েই তার সময় কাটছে।

এবারের নির্বাচনে লড়াই করা ছয় প্রার্থীর মধ্যে একমাত্র মাসুদ পেজেশকিয়ানকেই কিছুটা উদারমনা ও সংস্কারপন্থি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তার নির্বাচনী এজেন্ডাগুলোর মধ্যে ইরানের কঠোর হিজাব আইন সংস্কার এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ছিল অন্যতম।

পেজেশকিয়ানের মতে, ইরানকে অবশ্যই বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির কিছু সংস্করণ ফের চালু করার জন্য পশ্চিমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান তিনি।

ক্ষমতাগ্রহণের পর এসব বিষয়ে বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে পেজেশকিয়ান বিপুল সমর্থন পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে নিজ দেশের সরকারের কাছেই বাধার মুখে পড়তে পারেন তিনি।

কারণ, ইরানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সিদ্ধান্তই শেষ কথা। তাছাড়া, সরকারের অন্য পদগুলোতে এখনো রক্ষণশীলদের আধিপত্য রয়েছে। ফলে, হিজাব আইন সংস্কার বা পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করতে হলে পেজেশকিয়ানকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে, তা বলাই বাহুল্য।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, পেজেশকিয়ানকে ভোট দেওয়া অধিকাংশই তরুণ বলে মনে হচ্ছে। ২০২২ সালে পোশাক বিধি লঙ্ঘন করায় নৈতিক পুলিশের নির্যাতনে মাশা আমিনি নামের এক তরুণীর মৃত্যুর পরই ওই ঘটনার সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছিলেন পেজেশকিয়ান।

ওই তরুণীর মৃত্যুর পর পুরো ইরানজুড়ে তখন ব্যাপক আকারে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় পেজেশকিয়ান ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে ব্যাখ্যাও চেয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, একটি মেয়েকে তার হিজাবের জন্য গ্রেফতার করা এবং পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্রে অগ্রহণযোগ্য।

গত ২৮ জুন অনুষ্ঠিত ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট দিয়ে পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, হিজাব আইনের প্রতি আমাদের সম্মান জানানো উচিত। কিন্তু এর জন্য নারীদের প্রতি অমানবিক আচরণ করাও উচিত নয়।

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনের আগে এক ভিডিও বার্তায় পেজেশকিয়ান ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, চেষ্টা করেও আমি যদি আমার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হই, তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিদায় জানাব।

ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফায় তিন কোটির বেশি ভোট গণনার পর মাসুদ পেজেশকিয়ান পেয়েছেন ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি ভোট। অপরদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাইদ জালিলি পেয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি ভোট। 

ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফলাফল ঘোষণা করার আগেই পেজেশকিয়ানের সমর্থকরা তেহরান ও অন্যান্য কয়েকটি শহরে বিজয় উদযাপনের জন্য রাস্তায় নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, যারা বিজয় উল্লাসে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ। কেউ বের হয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে, সবুজ পতাকা হাতে, কেউ কেউ নেমে আসেন রাস্তায়।

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।