ভারতে মোদী সরকারের নতুন ৩ আইন নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৩৫ পিএম, ০২ জুলাই ২০২৪
ছবি সংগৃহীত

বিতর্ক সঙ্গে নিয়েই ভারতে ১ জুলাই থেকে কার্যকর হলো নতুন তিনটি অপরাধমূলক আইন। বিরোধীদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এই তিন আইন কার্যকর করেছে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কিন্তু কেন এই আইনগুলো ঘিরে এত বিতর্ক? কী পরিবর্তনই বা এসেছে নতুন আইনগুলোতে?

ভারতের বিরোধী শিবিরগুলো নির্বাচনের আগে থেকে বলে আসছিল, এবার পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলে ‘সংবিধান পরিবর্তন’ করতেও পিছপা হবে না মোদী সরকার। সেটি না হলেও শরিক-নির্ভর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই এমন আইন কার্যকর করেছে, যার বিল প্রায় একতরফাভাবে পার্লামেন্টে পাস করানো হয়েছিল বলে সরব হয়েছিলেন বিরোধীরা।

আরও পড়ুন>>

গত বছর কণ্ঠ ভোটে পাস হয়েছিল এই আইন সংক্রান্ত বিল। সেসময় বিরোধীদের পাশাপাশি আইনজ্ঞরাও বলেছিলেন, যে আইন দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বদলে দেবে, তা নিয়ে পার্লামেন্টে পূর্ণাঙ্গ তর্ক হওয়া উচিত, যেটি হয়নি।

পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পাস হওয়ার সময় এই বিল নিয়ে তর্ক হয়েছিল মাত্র পাঁচ ঘণ্টা এবং সেই সময় ১৪০ জনেরও বেশি বিরোধী সংসদ সদস্যকে পার্লামেন্টে থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

কার্যকর হওয়া নতুন তিনটি অপরাধমূলক আইন হলো- ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ (ভারতীয় দণ্ডবিধি)-এর পরিবর্তে ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’, ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ (ফৌজদারি বিধি)-এর পরিবর্তে ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ এবং ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ (ভারতীয় সাক্ষ্য আইন)-এর বদলে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মতে, পুরোনো আইনগুলোতে এতদিন সাজার কথা বলা ছিল। কিন্তু নতুন আইনে ‘সাধারণ মানুষের ন্যায়ের কথা বলা হয়েছে’।

মোদী সরকারের দাবি, নতুন আইনে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা, নারী ও শিশু সুরক্ষা, ন্যায় বিচার পাওয়া, সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও।

যদিও আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীদের মত একেবারে আলাদা। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী কলিন গোঞ্জালভেস বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, ঔপনিবেশিক দমনমূলক আইনকে বদলে ফেলতে এই নতুন আইন বলবৎ করা হচ্ছে, তা শুনে হতবাক হয়েছিলাম। কারণ এই আইন ব্রিটিশ আইনের চেয়ে ১০ গুণ খারাপ।

তার কথায়, কল্পনা করা যায় স্বাধীন ভারতে এমন আইন বলবৎ হচ্ছে, যা ব্রিটিশ আমলের চেয়েও বেশি দমনমূলক! আবার এই সব কিছুই করা হচ্ছে নাকি ঔপনিবেশিক আইন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য!

আরও পড়ুন>>

মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী এবং এপিডিআর-এর সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূর বলেন, এই আইন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন করবে। পুলিশের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা তুলে দেওয়ার ফলে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে।

কী বলছে বিরোধীরা?

নতুন আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম। তার অভিযোগ, পর্যাপ্ত আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়াই তিনটি নতুন বিল আনা হয়েছিল।

সোমবার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাফর্ম এক্সে (সাবেক টুইটার) তিনি লিখেছেন, তথাকথিত নতুন আইনের ৯০-৯৯ শতাংশই কাট, কপি অ্যান্ড পেস্টের কাজ। যে কাজ বিদ্যমান তিনটি আইনে কয়েকটা সংশোধনী এনেই করা যেতো, তা পরিণত হয়েছে অপচয়মূলক অনুশীলনে।

‘হ্যাঁ, নতুন আইনে কিছু উন্নতি হয়েছে এবং আমরা সেগুলোকে স্বাগত জানিয়েছি। তবে তা সংশোধনী হিসেবে পেশ করা যেতো। অন্যদিকে, বেশ কয়েকটা পশ্চাদমুখী বিধান রয়েছে। কিছু পরিবর্তন প্রাথমিকভাবে অসাংবিধানিক।’

এই তিন বিল নিয়ে স্থায়ী কমিটির সংসদ সদস্যরা যে পৃথক মতপ্রকাশ করেছিলেন, সে বিষয়ে সরকার নিশ্চুপ ছিল। সেই সমালোচনা খণ্ডন করেনি সরকার, পার্লামেন্টেও এ নিয়ে তেমন আলোচনা বা তর্কের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে, এক সপ্তাহ আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে এই আইন পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যা গ্রাহ্য করা হয়নি। অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলোর ‘আপত্তির’ মধ্যেই এই তিন আইন কার্যকর হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

দেশদ্রোহিতা ও সন্ত্রাসদমন সংক্রান্ত বিধি নিয়ে শুরু থেকেই বিজেপিকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। নতুন আইনে সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত কথা না থাকলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেশের ‘সার্বভৌমতা ও ঐক্য’র যে কোনো বিরোধিতার ক্ষেত্রে শাস্তিদানের কথা বলে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, ‘সরকারের সমালোচকদের’ থামাতে ‘অপব্যবহার’ হতে পারে নতুন আইনের।

আরও পড়ুন>>

মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু একটু ঘুরিয়ে। এর পরিধি বেড়েছে, শাস্তি কঠোর হয়েছে।

‘অন্যদিকে, আগে ইউএপিএ কারও বিরুদ্ধে কার্যকর করতে হলে বিশেষ অনুমোদন লাগতো। যেমন- অরুন্ধতী রায়ের ক্ষেত্রে গভর্নর অনুমোদন দিয়েছিলেন। তেমন হওয়ার আর প্রয়োজন নেই। এখন পুলিশই এই ধারা দিতে পারবে। অর্থাৎ পুলিশের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

সমালোচনা করেছেন আইনজীবী কলিন গোঞ্জালভেসও। তার কথায়, নতুন আইন সাধারণ মানুষের পক্ষে- এমনটি বলা হলেও আদতে তা আরও বেশি দমনমূলক। এমনিতেই আমাদের দেশের আইন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। আর বিচারের নাম করে দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখা নিয়ে আমরা তেমন ভাবিত হই না।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের মতো বিশেষ আইনকে অন্য অপরাধ দমনের আইনের আওতায় আনতে পারে? দুটি ভিন্ন ভিন্ন আইন, ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের জন্য। এদের একসঙ্গে আনার অর্থ হলো আরও বেশি দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া।

এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি অন্য একটি প্রসঙ্গ আনেন। তার কথায়, পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে মারধর বা অত্যাচার নিয়ে বিচারক ডি কে বসুর যে নির্দেশ রয়েছে, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা আমল দেওয়ার কথা। কিন্তু এই আইনে তার প্রতিফলন নেই।

অনেক ক্ষেত্রে আইপিসি অনুযায়ী অপরাধের সংজ্ঞা ও শাস্তি একই থাকলেও নতুন আইনে ধারা অন্য। এর ফলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন রঞ্জিত শূর।

তার কথায়, কাল পর্যন্ত এক ধরনের ধারা, আজ থেকে সেই একই অপরাধের ক্ষেত্রে অন্য ধারা দেওয়া হবে। এসব করতে গিয়ে বিচারব্যবস্থার কী হবে? আমাদের দেশে এমনিতেই এত মামলা ঝুলে রয়েছে। ঝুলে থাকা মামলাগুলোতে কীভাবে ন্যায় দেওয়া যায়, সে কথা তো বলছে না?

প্রবীণ আইনজীবী কলিন গোঞ্জালভেসও এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, পুলিশের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার অর্থ অপব্যবহার। আসলে পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার দরকার, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন বন্ধ করা দরকার। সে বিষয়ে কিছু করা হয়নি।

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।