হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেছেন লাদাখের বরফমানব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৪১ পিএম, ২০ জুন ২০২৪
ছবি সংগৃহীত

হিমালয়ে ফসলের খেতে সেচের পানি সরবরাহ করার জন্য কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করছেন স্থানীয় একজন প্রকৌশলী। সেখানে বৃষ্টি এবং তুষারপাতের অভাবে চাষাবাদে বেশ সমস্যা হচ্ছে। সে কারণেই নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন লাদাখের বরফমানব হিসেবে পরিচিত চেওয়াং নরফেল।

৫৮ বছর বয়সী দোলকর লাদাখের থিকসি গ্রামের একজন আলুচাষি। তিনি বলেন, আমার মনে আছে যখন আমি খুব ছোট তখন এখানে প্রচুর তুষারপাত হতো। সে সময় প্রায় আমার হাঁটুর সমান তুষারপাত হয়েছে। কিন্তু এখন এখানে তেমন একটা বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না।

দোলকরের পরিবারের কয়েক প্রজন্ম আলু চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তাদের আয় কমে গেছে। লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে ১৯ কিলোমিটার পূর্বে তার শহরটি ঘিরে আছে বরফে।

দোলকর জানান, আলু চাষ করে তারা প্রতি মাসে ৭০ হাজার রুপি আয় করতেন। কিন্তু এখন তা কমে ২০ হাজার রুপিতে ঠেকেছে। হিমালয়ের এ অঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জায়গাজুড়ে মেরু ক্যাপের বাইরের বৃহত্তম বরফের প্রতিনিধিত্ব করছে ৫৫ হাজার হিমবাহ।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এই ভঙ্গুর হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।

হিমালয়ের এক-তৃতীয়াংশ হিমবাহ পরবর্তী শতাব্দীর শেষ দিকেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, যা এশিয়ার নদীব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে। এই নদীব্যবস্থা থেকে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। এই গলিত হিমবাহের কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং প্রায় ১২ কোটি ৯০ লাখ কৃষকের জীবন-জীবিকা ব্যাহত হবে। লাদাখে দোলকর যেখানে বাস করেন সেই এলাকাও হুমকির মুখে আছে।

লাদাখের এই এলাকা বেশ ঠান্ডা এবং এখানকার জলবায়ু বেশ শুষ্ক। এখানে বার্ষিক প্রায় ৮৬ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ কৃষক তাদের ফসলের খেতে সেচের জন্য হিমবাহের ওপর নির্ভর করে। তবে গত ৩০ বছরে তুষারপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। ফলে হিমালয়ের বিভিন্ন গ্রামে হিমবাহ, অপর্যাপ্ত স্রোত এবং পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

কিন্তু দোলকরের গ্রামের স্থানীয় একজন প্রকৌশলী একটি উদ্ভাবনী কৌশল ব্যবহার করে এই হিমবাহ সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। থিকসির পাশের গ্রাম নাংয়ে সফলভাবে একটি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন চেওয়াং নরফেল নামের ওই প্রকৌশলী। তিনি এখন লাদাখের বরফমানব হিসেবেই বেশি পরিচিত।

এই কাজের জন্য বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেরিয়েছেন নরফেল। সে সময় তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষকই পানির ওপর নির্ভরশীল। হিমবাহ থেকে প্রবাহিত হওয়া পানি কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পানি শুধু জুনের মাঝামাঝি সময়েই প্রবাহিত হয়।

দীর্ঘ সময় শীত থাকার কারণে অব্যবহৃত পানি নদীতে প্রবাহিত হয়। কৃষি সম্প্রদায়ের জন্য এই অত্যাবশ্যকীয় পানি সংরক্ষণের জন্য নরফেল একটি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লাদাখ অঞ্চলের আরও ১০টি গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেন।

চেওয়াং নরফেল বলেন, আমরা পানি তৈরি করতে পারি না। তাই আমাদের একমাত্র বিকল্প উপায় হচ্ছে এই সম্পদকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা।

নাং গ্রামটি লাদাখ অঞ্চলের লেহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৭৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এই গ্রামে ৩৩৪ মানুষের বসবাস। এখানকার প্রাথমিক জীবিকা হলো কৃষি, যার প্রধান ফসল আলু ও গম। নাংয়ে স্থায়ী হিমবাহ নেই। প্রাকৃতিক ঝরনা থেকে এখানে পানি সরবরাহ করা হয়। এখানকার চাষাবাদের মৌসুম এপ্রিল ও মে মাসে। কিন্তু এই সময়টায় কৃষকদের চাহিদা মেটাতে এখানে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না।

এর ফলে বসন্তকালে গম, আলু এবং অন্যান্য ফসল ফলানোটা একটা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রীষ্মের আগে সেখানে হিমবাহ থেকে পানি পাওয়া যায় না।

নরফেল জানান, সেখানকার প্রধান হিমবাহ থেকে কেবল জুন মাসেই পানি পাওয়া যায়। একটি বিষয় থেকে তিনি হিমবাহের পানিকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহারের ধারণা পান। তিনি জানান, তার বাড়ির পেছনের বাগানের কল শীতকালে বাগানে সেচ দিতে চালু রাখা হয়। তিনি বলেন, আমরা পানির স্রোত চলমান রাখতে কলের মুখগুলো খুলে রাখি। তা না হলে পাইপের মধ্যেই পানি বরফ হয়ে যাবে এবং এটি ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি দেখলেন, তার বাগানে কল থেকে পড়া পানি থেকেই ছোট বরফ জমে আছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যদি অতিরিক্ত পানি নষ্ট না করে ধরে রাখা যায় এবং বরফে পরিণত করা যায় তবে তা থেকে তিনি পুরো গ্রামের জন্য একটি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করতে পারবেন।

 

এরপরেই নরফেল বিভিন্ন উচ্চতার একাধিক হিমবাহ তৈরি করেন। গ্রামের সবচেয়ে কাছের হিমবাহটি সর্বনিম্ন উচ্চতায় অবস্থিত। এটি প্রথমে গলে গিয়ে বসন্তে প্রাথমিক বপনের সময় প্রয়োজনীয় সেচের পানি সরবরাহ করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অতি উচ্চতায় থাকা পরবর্তী হিমবাহগুলো গলতে শুরু করে। পরবর্তীতে তা থেকে নিচের দিকের জমিতে সময়মতো সেচের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।