দেশে দেশে তাপপ্রবাহ-বন্যা-ঝড়, দুর্যোগের কবলে বিশ্ব
কয়েক সপ্তাহ ধরে রেকর্ডভাঙা তাপপ্রবাহের পর স্বস্তির বৃষ্টির দেখা মিলেছে বাংলাদেশে। কিন্তু একই সময় অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা দেখা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, কেনিয়ার মতো দেশগুলোতে। অন্যদিকে, শক্তিশালী টর্নেডোর কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একযোগে এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্ব এর আগে আর দেখেছে কি না, তার হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত এপ্রিলে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রেকর্ড ভেঙেছে তাপপ্রবাহ। এসময় ভয়ংকর দাবদাহের মুখে পড়ে বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো। দেশে দেশে বন্ধ ঘোষণা করা হয় স্কুল। ওই মাসেই নিজেদের ইতিহাসে এপ্রিলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক টর্নেডোর কবলে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। আবার, একই মাসে অভূতপূর্ব বৃষ্টিপাতে বন্যায় ডুবে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাত।
চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক গত কয়েক সপ্তাহে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে বিশ্বের কোন কোন দেশ-
দেশে দেশে দাবদাহ
বাংলাদেশ
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তপ্ত এপ্রিল গেছে গত মাসে। এবারের এপ্রিলে টানা যত দিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরেও হয়নি। গত মাসের ৩০ তারিখে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। মাসটিতে দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি ও ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। মে মাসের শুরুতে ঝড়-বৃষ্টির দেখা মিললেও মাসের শেষের দিকে দেশে আবারও তাপপ্রবাহ ফিরতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আরও পড়ুন>>
- টানা ৩৭ দিন পর দূর হলো তাপপ্রবাহ
- ভারতে ৫১ বছরের রেকর্ড ভাঙলো দাবদাহ, তাপমাত্রা ছাড়ালো ৪৭ ডিগ্রি
- ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ‘আর্দ্র এপ্রিল’ দেখলো পাকিস্তান
ভারত
কয়েক সপ্তাহ ধরে ভয়ংকর দাবদাহে পুড়ছে ভারতের বেশিরভাগ এলাকা। এর মধ্যে নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্তপ্ত এপ্রিল পার করেছে দক্ষিণ ভারত। আর উত্তরপূর্ব ভারতে ভেঙেছে ৫১ বছরের রেকর্ড। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের (আইএমডি) পরিসংখ্যান অনুসারে, পুরো মাসজুড়েই চরম উত্তপ্ত আবহাওয়া ছিল পূর্ব ভারতে। গত এপ্রিলে পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতে গড় তাপমাত্রা ছিল ১৯৭৩ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। তবে মাসটিতে রাতের গড় তাপমাত্রা ছিল ইতিহাসেরই সর্বোচ্চ। ওই মাসে পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুণ্ডায় তাপমাত্রা উঠেছিল রেকর্ড ৪৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
ভারতে তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। ছবি: এএফপি
দক্ষিণপূর্ব এশিয়া
বাংলাদেশ-ভারতের মতো প্রতিবেশী মিয়ানমারেও নতুন সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়েছে এপ্রিলের দাবদাহ। গত ২৮ এপ্রিল দেশটির চাউক শহরের তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ওই মাসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এবারের এপ্রিলে থাইল্যান্ডের অন্তত ৩৬টি জেলায় রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রা দেখা গেছে। থাই আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, গত এপ্রিলে দেশটির ২৬টি প্রদেশে তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ ল্যাম্পাংয়ে এ বছরের সর্বোচ্চ ৪৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
আরও পড়ুন>>
- থাইল্যান্ডে ৫২ ডিগ্রি ছাড়ালো হিট ইনডেক্স, বিদ্যুৎ চাহিদায় রেকর্ড
- মিয়ানমারে রেকর্ডভাঙা দাবদাহ, তাপমাত্রা ছুঁলো ৪৮.২ ডিগ্রি
- তীব্র গরমের পর অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের শঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ায়
একই মাসে উত্তর ও মধ্য ভিয়েতনামের বিভিন্ন অংশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি থেকে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে দুদিনের জন্য স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ফিলিপাইনে। এসময় জরুরি কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে না বেরোনোর পরামর্শ দেওয়া হয় সাধারণ মানুষকে।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার আরেক দেশ কম্বোডিয়ায় ১৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে সম্প্রতি। এ সপ্তাহেও দেশটির বিভিন্ন অংশে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
আফ্রিকা
শুধু এশিয়াই নয়, এ বছর আফ্রিকার অনেক দেশও প্রচণ্ড গরমের মুখোমুখি হচ্ছে। সম্প্রতি মালির কায়েস শহরে ৪৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। নাইজারের রাজধানীতে মে মাসের সবচেয়ে উষ্ণতম রাতের নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। বুরকিনা ফাসোর রাজধানীতে রেকর্ড হয়েছে যেকোনো মাসের জন্যই সবচেয়ে উষ্ণ রাতের। উত্তর মধ্য আফ্রিকার দেশ চাদে এ সপ্তাহেও তাপমাত্রার পারদ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
লাতিন আমেরিকা
লাতিন আমেরিকার প্রায় সর্বত্রই তাপপ্রবাহের নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। মেক্সিকোয় তাপমাত্রার পারদ উঠেছে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। মে মাসের সবচেয়ে উত্তপ্ত রাতের রেকর্ড ভেঙেছে বলিভিয়ায়। ব্রাজিলেও মে মাসের সবচেয়ে উত্তপ্ত দিনের নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে।
বন্যার কবলে যেসব দেশ
ভয়ংকর দাবদাহ যেতে না যেতেই বন্যার কবলে পড়েছে ব্রাজিল। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য রিও গ্র্যান্ডে দো সুলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। এতে এ পর্যন্ত ৯০ জন প্রাণ হারিয়েছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ।
বন্যা দেখা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়াতেও। দেশটির মধ্যাঞ্চলে বন্যা ও ভূমিধসে কমপক্ষে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন>>
- আমিরাতে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, তলিয়ে গেছে বিমানবন্দর
- ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যায় নিহত ৫৭, ঘরছাড়া ৭০ হাজার মানুষ
- বন্যায় বিপর্যস্ত কেনিয়ায় এবার কলেরার প্রাদুর্ভাব
বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে কেনিয়ার বিশাল অংশ। এতে ২৩৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন দুই লাখের বেশি মানুষ। কয়েক সপ্তাহের বৃষ্টি ও বন্যায় বিপর্যস্ত আফ্রিকান দেশটিতে এরই মধ্যে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
এপ্রিলে বন্যার কবলে পড়েছিল দুবাই। ছবি: এএফপি
গত এপ্রিলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের বন্যায় ডুবেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতও। দেড় বছরে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল দুবাইয়ে। এতে শহরটির প্রধান প্রধান সড়ক ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পানিতে ডুবে যায়। এপ্রিলের পর মে মাসের শুরুতেও প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে সতর্কতা জারি করতে হয়েছিল দুবাইয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রে ঝড়-বৃষ্টি
কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাতে তীব্র জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে টেক্সাসে। এর কারণে রাজ্যজুড়ে ছয় শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করতে হয়েছে কর্তৃপক্ষগুলোকে। এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিউস্টন শহর।
বৃষ্টির পাশাপাশি শক্তিশালী টর্নেডোও মোকাবিলা করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। দেশটির ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি টর্নেডো আঘাত হানার কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে আটটি টর্নেডো আঘাত হানে ওকলাহোমায়। আর কানসাস, সাউথ ডাকোটা, আইওয়া, নেব্রাস্কা, মিসৌরি এবং টেনেসিতে আঘাত হেনেছে একটি করে টর্নেডো।
সূত্র: এপি, আল-জাজিরা, খালিজ টাইমস, রয়টার্স
কেএএ/