ভারতে দূরদর্শনের লোগোর রং বদলে ‘গেরুয়া’ করা নিয়ে বিতর্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:২৮ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
ছবি সংগৃহীত

ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্প্রচার সংস্থা প্রসার ভারতীর চ্যানেল ‘ডিডি নিউজ’-এর লোগো লাল থেকে ‘গেরুয়া’ করে দেওয়া হয়েছে। লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন দূরদর্শনের এই লোগোর রং পরিবর্তন ঘিরে তীব্র সমালোচনায় সরব হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।

তাদের দাবি, লোগোর রং গেরুয়া করার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে এবং বিরোধীদের সেই অভিযোগের নিশানার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি।

এই ঘটনার সমালোচনা করেছেন রাজ্যসভার সদস্য ও প্রসার ভারতীর সাবেক সিইও জহর সরকারও। তিনি বলেছেন, এটি প্রসার ভারতী নয়, এটি প্রচার ভারতী।

আরও পড়ুন>>

যদিও লোগোর রং পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রসার ভারতীর বর্তমান সিইও গৌরব দ্বিবেদী। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, লোগোতে উজ্জ্বল রং কেবল বাণিজ্যিক কৌশল হিসাবেই ব্যবহৃত হয়েছে, রাজনীতির সঙ্গে এর কোনো সংযোগ নেই।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে ‘দূরদর্শন পোথিগাই’ টেলিভিশন চ্যানেলের নাম বদল করে ‘ডিডি তামিল’ করে দেওয়া হয়। সেই সময় বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। চ্যানেলটির লোগোতেও রং পরিবর্তন করে ‘গেরুয়া’ করা হয়েছে।

প্রসার ভারতীর সিদ্ধান্তের সমালোচনা
দূরদর্শনের লোগো পরিবর্তনের তীব্র নিন্দা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, আমি অবাক হয়ে দেখছি, যখন দেশজুড়ে সাধারণ নির্বাচন চলছে, তখন হঠাৎই দূরদর্শনের লোগোর রং বদলে গেরুয়া করে দেওয়া হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং বেআইনি।

এই ঘটনার সঙ্গে বিজেপি-যোগের উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নও করেছেন তিনি। মমতা বলেন, বিজেপির প্রতি সরকারি সম্প্রচার সংস্থার পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে অনেক কিছুই বলে এই পদক্ষেপ। ভোটের সময় গেরুয়া সমর্থনে এমন প্রচারের অনুমতি নির্বাচন কমিশন দিলো কীভাবে? নির্বাচন কমিশনের উচিত অবিলম্বে এটি বন্ধ করা এবং দূরদর্শনের লোগোর পুরোনো রং ফিরিয়ে আনা।

প্রসার ভারতীর সাবেক সিইও জহর সরকারের মতে, নতুন লোগো দেখে মনে হয়, কোনো বিশেষ দলের প্রচার করা হচ্ছে।

জহর সরকার ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রসার ভারতীর সিইও ছিলেন। বর্তমানে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য।

ডিডি নিউজের লোগোর রং বদলে গেরুয়া হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের সরকারি সম্প্রচারক দূরদর্শনের ঐতিহাসিক লোগোতে গেরুয়া রং করা হয়েছে। একজন সাবেক সিইও হিসেবে আমি দূরদর্শনের গেরুয়াকরণকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি। এটি এখন আর প্রসার ভারতী নেই, এটি একটা বিশেষ দলের প্রচার ভারতী।

আরও পড়ুন>>

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিওতেও তিনি একই বার্তা দিয়েছেন। জহর বলেন, এটি দুঃখজনক যে, সরকারি চ্যানেল তাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য এই রং বেছে নিয়েছে। সেটি কমলা বা অন্য কোনো রং করতে পারতো। কিন্তু একে সাধারণত গেরুয়া বলা হয় এবং এটি একটা নির্দিষ্ট ধর্মের সঙ্গে যুক্ত।

জহর সরকার বলেন, এর মাধ্যমে দেশ, সরকার, দল, সংগঠন ও ধর্মের মধ্যে পার্থক্যকারী রেখাগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলো।

তিনি বলেন, লাখ লাখ মানুষ এটি দেখেন। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের রং ছড়ানোর জন্য এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা ঠিক নয়। এখন আপনি বলতেই পারেন, জাতীয় পতাকাতেও এই রং রয়েছে। তবে সেখানে অন্যান্য রঙের সঙ্গে রয়েছে এটি।

দূরদর্শনের ‘গেরুয়াকরণ’ হচ্ছে?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দূরদর্শনে কর্মরত এক কর্মকর্তা বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, যখন দূরদর্শন শুরু হয়েছিল, তখন এটি একটি ক্ষমতাসীন সরকারের চ্যানেলের ব্যানারে চালু হয়েছিল। কিন্তু সেসময় কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারেনি, এই চ্যানেলের উদ্দেশ্য কী এবং এর উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায় কী হবে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ঠিক যেভাবে বিএসএনএল (ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড)-এর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে, দূরদর্শনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। দূরদর্শনে কী হচ্ছে তা জানার, শোনার কেউ নেই। এ কারণে পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় গুটিকয়েক মানুষের হাতে।

‘পক্ষপাতের’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদি দূরদর্শনে নির্বাচনী প্রচারণার কোনো ভিডিও আসে, তাহলে সেখানে প্রত্যেককে সমান অধিকার দেওয়া উচিত। কিন্তু ভিডিও যে রাজ্যে দেখানো হচ্ছে, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি বিরোধী দলের হন, তাকে রাখা হচ্ছে সপ্তম স্থানে। অথচ কোনো পদে নেই এমন একজন বিজেপি নেতাকে রাখা হচ্ছে তৃতীয় স্থানে এবং (ভিডিওতে) বেশি সময়ও দেওয়া হচ্ছে। এখানে সমতা কোথায়?

আরও পড়ুন>>

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, একটি নির্দিষ্ট দলের লোকদেরই দূরদর্শনে চাকরি দেওয়া হয়। এই একই ঘটনা ঘটছে ডিডি তামিলেও। সম্প্রতি এক সেলিব্রিটিকে একটি মেগা সিরিয়ালে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছিল। তিনি এখন বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, কিছু কর্মচারী একতরফা পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদ করছেন বটে। কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না। দূরদর্শনের উন্নতির জন্য আরও অনেক সৃজনশীল উপায় রয়েছে। এ ধরনের গেরুয়াকরণের কোনো কার্যকারিতা নেই।

গেরুয়াকরণকে ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা
তামিলনাড়ু প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অধবন দিতসানিয়া বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় মিডিয়া পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, এটি কোথাও না কোথাও গেরুয়া হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে আরও কয়েকটি উদাহরণের উল্লেখ করেছেন তিনি। দিতসানিয়া বলেন, আইআরসিটিসি (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন)-এর মোবাইল অ্যাপ, বন্দে ভারত ট্রেন— এগুলো কয়েকটি মাত্র উদাহরণ। সর্বত্র গেরুয়া রং এনে গেরুয়াকরণকে স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করছে তারা।

দূরদর্শনের সিইও কী বলছেন?
প্রসার ভারতীর বর্তমান সিইও গৌরব দ্বিবেদী ডিডি-র লোগোর রং বদলের বিষয়ে যে ধরনের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো অস্বীকার করেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, নতুন লোগোটি কমলা রংয়ের, আর এই পরিবর্তন কোনো দল বা নির্দিষ্ট কোনো রংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

আরও পড়ুন>>

গৌরব সাংবাদিকদের বলেন, এটি কমলা রং। ছয়-সাত মাস আগে আমরা ডিডি ইন্ডিয়ার (ইংরেজি খবরের চ্যানেল) লোগো ওই একই রংয়ে আপডেট করেছিলাম। এরপর আমরা নতুন গ্রাফিক্সের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেই।

‘ভিজ্যুয়াল এবং প্রযুক্তির স্তরে ডিডি নিউজের একটি নতুন অবতার শুরু করেছি আমরা। শুধু চ্যানেলের লোগো নয়, নতুন জায়গা, আধুনিক যন্ত্রপাতি, উপস্থাপনার নতুন ধরনসহ অনেক নতুন পরিবর্তন আনা হয়েছে।’

তিনি বলেছেন, এর আগেও আমরা দূরদর্শনের লোগোতে নীল ও হলুদ রং ব্যবহার করেছি। লোগোতে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করা বিজ্ঞাপন কৌশলের অংশ। সুতরাং এই পরিবর্তনগুলো চ্যানেলের স্বার্থে। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।