লালগালিচা, ডুবুরি, সন্ন্যাসী
ভারতের নির্বাচনে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে ১৮তম লোকসভা নির্বাচন। আগামী ১ জুন পর্যন্ত মোট সাত ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এবারের ভোটগ্রহণ। ভারতে এবারের নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৯৬ কোটি, তারাই বেছে নেবেন ৫৪৩টি লোকসভা আসন থেকে কারা পার্লামেন্টে যাবেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন বলছে, এই ৯৬ কোটি ভোটারের প্রত্যেকের ভোটই অত্যন্ত মূল্যবান। তারা দেশের যে প্রান্তে, যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, ভোটের বাক্সে তারা যেন নিজেদের মতামত খুব সহজে ও মসৃণভাবে দিতে পারেন, তার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না।
আরও পড়ুন>>
- ভারতে লোকসভা নির্বাচন শুরু ১৯ এপ্রিল, ফলাফল ৪ জুন
- ভারতে এই অসহ্য গরমে ভোট করানোর নেপথ্যে যে রাজনীতিবিদ
ভারতে নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসও বলে, অতীতে তারা মাত্র একজন ভোটারের জন্য কিংবা দেশের প্রত্যন্ত কোনো প্রান্তে হাতেগানা কয়েকজন ভোটারের কাছে পৌঁছানোর জন্য যে পরিমাণ মেহনত করেছে বা ঝুঁকি নিয়েছে, তা চোখ কপালে তোলার মতো।
প্রথম ভোটারকে ছাড়া প্রথম ভোট
স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম ভারতে কোনো সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে, যেখানে শ্যামশরণ নেগি ভোট দেবেন না! তিনি ‘ভারতের প্রথম ভোটার’ হিসেবে স্বীকৃত।
নেগি ছিলেন পার্বত্য রাজ্য হিমাচল প্রদেশের দুর্গম কল্পা অঞ্চলের বাসিন্দা। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ১০৫ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
শ্যামশরণ নেগি।
শতবর্ষী এই অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের মৃত্যুর পর প্রকাশ্য জনসভায় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিজ গ্রামে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নেগির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল।
আরও পড়ুন>>
- প্রার্থী তালিকায় বড় চমক মমতা ব্যানার্জীর, নেই মিমি-নুসরাত
- তফশিলের আগেই বিজেপির ১৯৫ প্রার্থীর নাম ঘোষণা
এই বিরল সম্মানে তাকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছিল, কারণ শ্যামশরণ নেগি সম্ভবত ভারতের একমাত্র নাগরিক – যিনি এ যাবৎ দেশটিতে হওয়া সবগুলো সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালের এপ্রিলে ভারতে প্রথম লোকসভা গঠনের প্রায় পাঁচ মাস আগে ভোটগ্রহণ হয়েছিল হিমাচলের কল্পায়। কারণ গোটা শীতকালই হিমালয়ের ওই অঞ্চলটা ঢেকে থাকে পুরু বরফের চাদরে।
তখনই জীবনে প্রথমবার স্বাধীন ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে ভোট দেন শ্যামশরণ নেগি। তিনি তখন সদ্য ৩০ পেরোনো যুবক।
সেবারেরটা নিয়ে মোট ১৭ বার ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন নেগি। একবারের জন্যও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। আর শেষবার লোকসভার জন্য তিনি ভোট দিয়েছিলেন ২০১৯ সালের গ্রীষ্মে।
২০১৭ সালে হিমাচলের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিতে যাচ্ছেন শ্যামশরণ নেগি। ছবি: সংগৃহীত
সেবার নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা নেগির বাড়িতে গিয়ে রীতিমতো মিছিল করে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পোলিং বুথে। পথে কাঁসর-বাদ্য বাজিয়ে ও হিমাচলের সাবেকি রীতিতে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
আরও পড়ুন>>
- নির্বাচনের আগে কেন সিএএ কার্যকর করলো মোদী সরকার?
- ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ দেয় যেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান
- ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ‘অপব্যবহার’ হচ্ছে?
মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগেও তিনি একটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ২০২২ সালে হিমাচল প্রদেশের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন।
সেবার অবশ্য খুব অসুস্থ ছিলেন বলে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেন শ্যামশরণ নেগি। নির্বাচন কমিশন তার বাড়ির সামনে লালগালিচা বিছিয়ে সসম্মানে সেই ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে আনে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশের নির্বাচন কমিশন শ্যামশরণ নেগিকে তাদের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
ডুবুরি নিয়ে পোলিং বুথে!
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের ওয়েস্ট জৈন্তিয়া হিলস জেলার এক প্রান্তে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে কামসিং নামে একটি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সারিগোয়াইন নদী, যার মাঝবরাবর টানা হয়েছে সীমান্তরেখা। কামসিংয়ের ঠিক উল্টো দিকে বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলা।
দুর্গম ও পাহাড়ি গ্রাম কামসিংয়ে আজ পর্যন্ত বিদ্যুতের খাম্বা বসেনি। সৌর বিদ্যুতের কয়েকটি প্যানেলই গ্রামবাসীর ভরসা। গ্রামে বাস করে মাত্র ২০-২৫টি পরিবার। পাহাড়ের কোলে পানের চাষ করেই চলে তাদের রুটি-রুজি।
ভোটের সময় ভারতের সবচেয়ে প্রত্যন্ত বা দুর্গম যেসব এলাকায় নির্বাচন কমিশনকে পোলিং বুথ স্থাপন করতে হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম এই কামসিং।
আরও পড়ুন>>
- মনোনয়ন নিয়ে ‘বিবাদ’, ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করলেন মমতা
- জনসংযোগে গিয়ে নিজের হাতে চা বানালেন মমতা
- বিয়ের কার্ডে অনুরোধ/ উপহার লাগবে না, মোদীকে ভোট দিন
গ্রামটিতে মোটরগাড়িতে চেপে পৌঁছনোর কোনো উপায় নেই। কারণ সেখানে কোনো রাস্তাই নেই। জেলা সদর জোওয়াই থেকে গ্রামটি ৬৯ কিলোমিটার দূরে, আর সবচেয়ে কাছাকাছি মহকুমা বা তহসিলদার অফিস যে আমলারেমে, সেটিও কামসিং থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে।
কামসিংয়ে পৌঁছনোর একমাত্র রাস্তা হলো সারিগোয়াইন নদী বেয়ে ছোট, সরু দেশি নৌকায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলা।
নৌকায় কামসিং গ্রামের পথে ভোটকর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত
ফলে প্রতিবার ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনকে নৌকাতে করেই ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ও ইভিএমসহ ভোটের সব সরঞ্জাম কামসিং গ্রামের পোলিং বুথে পাঠাতে হয়।
নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে, কামসিংয়ে যাওয়ার সময় নৌকায় আমাদের পোলিং অফিসারদের সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরতে হয়। নৌকা ডুবে কারও জীবন সংশয় হলে বা ভোটের সরঞ্জাম পানিতে পড়ে গেলে যেন উদ্ধার করা যায়, সে জন্য কয়েকজন ডুবুরিও এই যাত্রায় তাদের সঙ্গে থাকেন।
ভারতের কোনো প্রান্তে একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য অভিজ্ঞ ও পেশাদার ডুবুরিদেরও সঙ্গে যেতে হচ্ছে – এমন দৃষ্টান্ত সারা দেশে আর একটিও নেই!
আরও পড়ুন>>
- নির্বাচনের আগে তৃণমূলের ইশতেহার, ‘দিদির ১০ শপথ’ পূরণের অঙ্গীকার
- বিএসএফ’কে দিয়ে যারা অত্যাচার করায়, তাদের ভোট দেবেন না: মমতা
- ‘মোদী-অমিত শাহ’র হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাও’
গত নির্বাচনে দুর্গম কামসিং গ্রামে ছিলেন মাত্র ৩৫ জন ভোটার – ২০ জন পুরুষ ও ১৫ জন নারী। কিন্তু দেশের গণতন্ত্রে তাদের ভূমিকা অন্য যেকোনো নাগরিকের চেয়ে এতটুকু কম নয়, সে জন্যই এত কষ্ট করে ওই গ্রামে নিজস্ব পোলিং বুথ তৈরি করা হয় বলে জানিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।
জঙ্গলে একলা সন্ন্যাসীর পোলিং বুথ
ভারতের গুজরাটে ‘গির ফরেস্ট’ হলো সারা পৃথিবীতেই এশিয়াটিক লায়ন প্রজাতির শেষ টিঁকে থাকা আবাসভূমি।
সিংহের এই অভয়ারণ্যে, গির’র গভীর জঙ্গলের ভেতরে সেই ২০০৭ সাল থেকে নির্বাচন কমিশন প্রতিবার ভোট এলেই একটি বিশেষ ভোটগ্রহণ কেন্দ্র তৈরি করে আসছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
জঙ্গলের ভেতরে ‘বানেজ’ নামে একটি জায়গার কাছে ওই পোলিং বুথটিতে মাত্র একজনই নথিভুক্ত ভোটার– তার নাম মহন্ত হরিদাসজী উদাসীন।
ভোট দিতে এসেছেন মহন্ত হরিদাসজী উদাসীন। ছবি: সংগৃহীত
আসলে ওই জঙ্গলের ভেতরে রয়েছে হিন্দুদের একটি প্রাচীন শিবমন্দির। মহন্তজি ওই মন্দিরের পুরোহিত এবং উদাসীন আখড়ার একজন সন্ন্যাসী।
মন্দির প্রাঙ্গণে হরিদাস একাই থাকেন। ওই জঙ্গলের ত্রিসীমানায় আর কোনো জনবসতি নেই। ফলে অনেকটা অঞ্চলজুড়ে তিনিই হলেন একমাত্র ভোটার।
এই বিচিত্র কাহিনি দেশের নির্বাচন কমিশন শুনিয়েছে ‘লিপ অব ফেইথ’ নামে তাদের সদ্যপ্রকাশিত একটি পুস্তিকায়। তারা সেখানে জানিয়েছে, মহন্ত হরিদাস উদাসীন হলেন আসলে মহন্ত ভরতদাস দর্শনদাসের উত্তরসূরী, যিনি আগে ওই শিবমন্দিরের প্রধান পূজারী ছিলেন। প্রায় দীর্ঘ দুই দশক ধরে মহন্ত ভরতদাসজি ছিলেন ওই পোলিং বুথের একমাত্র ভোটার।
২০১৯ সালের নভেম্বরে তিনি প্রয়াত হলে মহন্ত হরিদাসজী তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং এই মুহুর্তে তিনিই ওই বুথের একমাত্র ভোটার।
গুজরাটের এই বিশেষ বুথটি ছাড়াও সুদূর চীন সীমান্তে অরুণাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম মালোগামেও রয়েছে আর একটি পোলিং স্টেশন, যেখানে নথিভুক্ত ভোটারের সংখ্যা মাত্র একজন।
আরও পড়ুন>>
- ‘মোদীর গ্যারান্টি জিরো, আমাদের গ্যারান্টি হিরো’
- নির্বাচনের সময়ও কারাগারে থাকছেন কেজরিওয়াল
- বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ
২০১৯ সালে মালোগামের সেই একাকী ভোটারের কাছে পৌঁছাতে নির্বাচন কমিশনের কর্মীদের টানা চারদিন ধরে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা আর খরস্রোতা নদী উপত্যকা পাড়ি দিতে হয়েছিল।
ভারতের নির্বাচন কমিশন বলছে, এত ঝামেলাঝক্কি সামলেও তারা মাত্র একজন ভোটারের জন্য এই আয়োজন করতে প্রস্তুত। কারণ তাদের নীতি হল ‘এভরি ভোট কাউন্টস’ – অর্থাৎ প্রতিটি ভোটেরই মূল্য রয়েছে।
কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়, কারণ ভারতে নানা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতেও তার একাধিক উদাহরণ আছে।
এমনকি, দেশের লোকসভা আসনগুলোতে– যেখানে গড় ভোটারের সংখ্যা বেশ কয়েক লাখ করে– সেখানেও জয়ের ব্যবধান দুই অংকে যায়নি (মানে ১০টিরও কম ছিল), এ ধরনের অন্তত দুটি দৃষ্টান্ত রয়েছে।
১৯৮৯ সালে অন্ধ্রের অনকাপল্লি আসনে কংগ্রেসের কোনাথালা রামকৃষ্ণ আর ১৯৯৮ সালে বিহারের রাজমহল আসনে বিজেপির সোম মারান্ডি – এরা দুজনেই জিতেছিলেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে মাত্র নয় ভোট বেশি পেয়ে।
এ ধরনের অদ্ভুত সব ঘটনা, অভিনব নানা পদক্ষেপ আর চোখ কপালে তোলা পরিসংখ্যানই যে ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে এত বর্ণময় ও বৈচিত্রপূর্ণ করে তুলেছে, তাতে সন্দেহ নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/