ভারতে এই অসহ্য গরমে ভোট করানোর নেপথ্যে যে রাজনীতিবিদ
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত মোট সাতটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচন। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি গরম থাকে যে মাসগুলোতে, ঘটনাচক্রে ঠিক তখনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এই উৎসব।
অথচ এর আগে, মাঝে দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, গত শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে শরৎ বা শীতের মনোরম আবহাওয়াতে।
কিন্তু দু’দশকের ওপর হলো চরম গ্রীষ্মেই ভোট হচ্ছে ভারতে লোকসভার। ফলে ২০০৪ থেকে শুরু করে এ নিয়ে টানা পঞ্চমবার অসহ্য গরমে ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে ভারতীয়দের।
আর এই যে এত গরমে ভোট হচ্ছে– তার জন্য হয়তো দায়ী করা চলে দেশটির একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদকে।
না, তিনি বিজেপি বা কংগ্রেস– জাতীয় পর্যায়ের কোনো দলের নন, বরং ভারতের একটি আঞ্চলিক দলের নেতা!
এত গরমে ভোট কেন?
গ্রীষ্মপ্রধান ও ‘ট্রপিক্যাল’ দেশ ভারতে এপ্রিল-মে-জুনেই তাপমাত্রা থাকে সর্বোচ্চ। দেশটির একটা বিস্তীর্ণ অংশে এ সময় দিনের পর দিন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ঘোরাফেরা করে।
রাজস্থানের মরু অঞ্চল, উড়িষ্যার কালাহান্ডি বা বোলাঙ্গিরের মতো এলাকাগুলোতে দিনেরবেলা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৬ বা ৪৭ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যায় প্রায়শই। ‘লু’ বা তাপপ্রবাহ এই সময় ভারতের বেশিরভাগ অংশে খুব সাধারণ ঘটনা।
আবার কোথাও কোথাও ৪০ ডিগ্রি ছাড়ানো তাপমাত্রার পাশাপাশি বাতাসের ভয়ংকর আর্দ্রতায় পরিস্থিতি হয়ে ওঠে অসহনীয়।
এই অসহ্য গরমে কাহিল হয়ে আর ঘামে ভিজে যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভোটের প্রচারে বেরোতে হয়, যে ভোটকর্মীদের নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করতে হয় বা যে সাংবাদিকদের ভোটের খবর সংগ্রহে পথে নামতে হয়– তাদের কারও জন্যই বছরের এই সময়টা স্বস্তিদায়ক নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!
আর ভোটের দিন পোলিং বুথে বিশেষ করে বয়স্ক নারী-পুরুষদের এই গরমে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাটাও কম কষ্টকর নয়!
ভারতের বর্ষীয়ান সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই এ কারণেই বলেছেন, আমার কথাটি হয়তো বিয়েবাড়িতে বাহানা তোলা প্রবীণ চাচার মতো শোনাবে, কিন্তু ভারতে কি আরেকটু ঠান্ডা সময়ে ভোট হতে পারতো না?
মজার ব্যাপার হলো, দেশটিতে কিন্তু ১৯৫১-৫২ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ পর্যন্ত প্রথম নয়টি সংসদীয় নির্বাচনই সম্পন্ন হয়েছে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময়কালের মধ্যে, অর্থাৎ শীতকালে বা তার আশপাশে।
কিন্তু ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর আচমকা পদত্যাগ করলে যখন নবম লোকসভা ভেঙে দিতে হয়, সেবারই প্রথম ভারতে সাধারণ নির্বাচন হয় মে-জুন মাসের ভয়ংকর গরমে।
পাঁচ বছর পর ১৯৯৬’র নির্বাচনও হয়েছিল এপ্রিল-মে মাসের দাবদাহে। কিন্তু পরপর দুটি লোকসভা তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারায় ঘটনাচক্রে আবার পরের দুটি নির্বাচন হয়েছিল শরতে বা শীতকালে।
১৯৯৯ থেকে ভারতে প্রতিটি লোকসভাই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করেছে বা করার মতো অবস্থায় ছিল। কাজেই ১৯৯৯ সালে যেভাবে অক্টোবর মাসে শরতের মনোরম আবহাওয়ায় দেশটিতে নির্বাচন হয়েছিল, সুযোগ ছিল তারপর থেকে সবগুলো নির্বাচনই বছরের ওই সময়টায় হবে।
কিন্তু রাজদীপ সারদেশাই জানাচ্ছেন– ভারতের একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের জন্যই সেটি সম্ভব হয়নি। তার নাম চন্দ্রবাবু নাইডু!
তিনি ছিলেন অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের কিংবদন্তি রাজনীতিক ও চিত্রতারকা ‘এনটিআর’র (নন্দমুরি তারক রামারাও) জামাতা ও তেলুগু দেশম দলের নেতা।
চন্দ্রবাবুর ‘আবদার’
আসলে তখন যা হয়েছিল, ২০০৪ সালেও ভারতের নির্বাচন অক্টোবর মাসেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও তেলুগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে অনুরোধ করেন, লোকসভা নির্বাচনটা বরং কয়েক মাস এগিয়ে আনুন।
তেলুগু দেশম তখন ছিল বিজেপি জোটের খুব গুরুত্বপূর্ণ শরিক। তাদের অনুরোধ ফেলা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও বেশ কঠিন ছিল।
রাজদীপ সারদেশাইয়ের কথায়, চন্দ্রবাবু নাইডু চেয়েছিলেন তার রাজ্যের বিধানসভা ভোট ও দেশের লোকসভা ভোট একসঙ্গে করাতে, যাতে বাজপেয়ীর উজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনিও জিতে যেতে পারেন।
‘বাজপেয়ী ও তার প্রবল আস্থাভাজন প্রমোদ মহাজন সেই অনুরোধ রক্ষা করে লোকসভা ভোট পাকা ছয় মাস এগিয়ে আনেন, আর নির্বাচন হয় এপ্রিল-মে মাসে!’
সেই নির্বাচনেই বিজেপি ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ ক্যাম্পেইনে ভর করে তুমুল প্রচার চালিয়েছিল, আর অটলবিহারী বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তেলুগু দেশমও।
তাতে অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি। শেষে দেখা যায়, বাজপেয়ী ও চন্দ্রবাবু দুজনেই সেবারের নির্বাচনে হেরে যান!, জানাচ্ছেন রাজদীপ সারদেশাই।
কিন্তু ততক্ষণে যাদের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে এবং সেই ২০০৪ সাল থেকে এ নিয়ে টানা পঞ্চমবার অসহ্য গরমেই গোটা ভারতকে ভোটের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে!
এতদিন তবু এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই ভোটগ্রহণ সীমাবদ্ধ ছিল, এবার তা গড়িয়েছে জুন মাসেও।
ফলে ভোটগণনা যেদিন হবে, তারও দিন চারেক বাদে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢুকবে বলে কথা রয়েছে। তখন হয়তো বৃষ্টি নামায় দেশ কিছুটা ঠান্ডা হতে শুরু করবে।
অটল বিহারী বাজপেয়ী ও প্রমোদ মহাজন দুজনেই আজ প্রয়াত। ফলে এত গরমে ভোট হচ্ছে বলে যারা বিরক্ত, তাদের গালিগালাজ সইবার জন্য হাতের কাছে রয়েছেন কেবল চন্দ্রবাবু নাইডুই! আর তিনিও সেই ২০ বছর আগের মতো এবারও বিজেপির সঙ্গে জোট গড়েই অন্ধ্রের ভোটে লড়ছেন।
এরই মধ্যে নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। চন্দ্রবাবু নাইডুও মাঝে বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে আবার সেই জোটেই ফিরে এসেছেন।
অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যটাও ভেঙে দিয়ে তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র– দুটি আলাদা রাজ্য গঠন করা হয়েছে ১০ বছরের ওপর হলো।
কিন্তু গত ২০ বছর ধরে চন্দ্রবাবু নাইডুকেও সেই তীব্র গরমে ঘেমেনেয়েই লোকসভা ভোটের প্রচার চালাতে হচ্ছে– তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/