সোমালি জলদস্যু কারা, তারা কতটা শক্তিশালী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৫১ পিএম, ১৩ মার্চ ২০২৪
সোমালিয়ার এক জলদস্যু। ফাইল ছবি: এএফপি

বেশ কয়েক বছর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সম্প্রতি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে সোমালি জলদস্যুরা। গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) তারা বাংলাদেশি একটি জাহাজ ছিনতাই করে ২৩ নাবিককে জিম্মি করেছে।

লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের গালফ অফ এডেনে সোমালি জলদস্যুরা আবার মাথাচাড়া দিয়েছে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।

উত্থানের নেপথ্যে
ইতালির ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়ার জন্ম। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসন উৎখাতের পরে নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে পূর্ব আফ্রিকার দেশটি।

পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমালিয়ায় কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। এ সময়ে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূলসমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড বা বাহিনীও ছিল না।

এতে এ অঞ্চলে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে, তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

আরও পড়ুন>>

ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতেও ওই সময়ের দস্যুতার নেপথ্যে এই কারণ দেখানো হয়েছে। তাছাড়া, মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি।

তবে, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে সোমালিয়দের দস্যুবৃত্তি।

সাম্প্রতিক হামলা
কিন্তু গত কয়েক মাসে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা আবারও বেড়েছে।

পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামুদ্রিক নিরাপত্তায় কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী বা ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা। তাদের হিসাবে, গত বছরের নভেম্বরে থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালিয়া উপকূলে অন্তত ১৪টি জাহাজ ছিনতাই করা হয়েছে।

এর মধ্যে ইরানের পতাকাবাহী একটি মাছ ধরার নৌকা এবং লাইবেরিয়ান পতাকাবাহী সেন্ট্রাল পার্ক নামে একটি জাহাজের জেলে ও নাবিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহজলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। ছবি সংগৃহীত

সেন্ট্রাল পার্কের উদ্ধার তৎপরতায় মার্কিন নৌবাহিনী জড়িত ছিল। পরে তারা জানায়, এটি স্পষ্টতই দস্যুতা এবং আক্রমণকারীরা সম্ভবত সোমালিই ছিল।

ডিসেম্বরে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ ছিনতাই করা হয়। এখনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হামলাকারীদের হাতে। জিম্মি রয়েছেন ১৭ জন ক্রু।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) মতে, এটি ছিল ছয় বছরের মধ্যে সোমালিয়ায় প্রথম সফল হাইজ্যাকিং।

আরও পড়ুন>>

গত জানুয়ারিতে ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এক সপ্তাহে তিনটি অভিযানে ১৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় তারা। তাদের মধ্যে ১১ জন ইরানি নাগরিক, বাকিরা পাকিস্তানি। ভারতীয় বাহিনীর তরফে জানানো হয়, এদের সবাই সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দি ছিলেন।

বিবিসি’র রিয়েলিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।

এর সবশেষ শিকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার ২৩ জন ক্রুসহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জলদস্যুরা।

হুথিদের ঠেকাতে গিয়ে অরক্ষিত সোমালিয়া উপকূল
দস্যুরা স্বভাবতই সুযোগসন্ধানী। তারা নিরাপত্তাবাহিনীকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে। এবার পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন।

তিনি বলেন, ২০০৫ থেকে ২০১২ সালে ব্যাপকভাবে জলদস্যুতা বেড়ে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাহিনী ওই জলসীমায় টহল জোরদার করে। কিন্তু সম্প্রতি লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা বেশ কিছু জাহাজে আক্রমণ করায় পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে সেদিকে বেশি নজর দিতে হয়েছে।

‘সামরিক দিক থেকে দেখলে, (হুথিদের) ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোনের আক্রমণ মোকাবিলা করা বেশি জরুরি। তাই, ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র সামাল দিতে গিয়ে জলদস্যুদের দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না তারা, যোগ করেন হেনিংসেন।

সোমালি জলদস্যুসোমালি জলদস্যু। ফাইল ছবি: এএফপি

দস্যুদের উদ্দেশ্য কী, আয় কেমন?
ত্রিকোণাকৃতির ভৌগোলিক মানচিত্রের কারণে পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলকে হর্ন অব আফ্রিকা বলা হয়। ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত হর্ন অব আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক।

সেই হিসাব অনুযায়ী, জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে ৩৫০ থেকে ৪২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে।

আরও পড়ুন>>

এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল বলেন, ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় বলেই ধারণা করা যায়। অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নেপথ্য এটিই মূল কারণ।

২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করে দস্যুরা। ২০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিল নৌযানটিতে। আটক দুই ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়।

পূর্ব আফ্রিকান জলদস্যুতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওয়েওল বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহুজাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতায় দস্যুদের প্রতিহত করা সম্ভব হয়। সুতরাং, ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য সবসময় পুরোপুরিভাবে জানা যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওশেন বিয়ন্ড পাইরেসির প্রতিবেদন বলছে, সাগরে দস্যুতার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৭ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার।

সোমালি দস্যুদের পুনরুত্থান?
আইওসি বলছে, সাম্প্রতিক হামলাগুলোর অন্তত ছয়টি জলদস্যুতা।

বিবিসি পক্ষ থেকে আইএমবি’র কাছে জানতে চাওয়া হয়, গত কয়েক মাসের হামলাগুলোকে কী হিসেবে দেখা হচ্ছে? জবাবে আইএমবি জানায়, বাণিজ্যিক জাহাজে হামলাগুলোকে শুধু জলদস্যুতা হিসেবেই শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।

ইউরোপীয় নৌবাহিনী এমভি রুয়েনের ইস্যুটিকে একটি টেস্টকেস হিসেবে দেখছে। তারা বলছে, এই জাহাজটির ভবিষ্যৎ থেকেই ইঙ্গিত মিলবে, ওই অঞ্চলে দস্যুতার পুনরুত্থান দেখা যাবে কি না। যদি এখান থেকে ভালো অর্থ আদায় করতে পারে, মৌসুমজুড়ে নৌ-ডাকাতি একটা লাভজনক পেশা হিসেবে আকৃষ্ট করতে পারে তাদের।

সবশেষ বাংলাদেশি জাহাজে আক্রমণ ক্রমবর্ধমান দস্যুবৃত্তিরই ইঙ্গিত দেয়।

আরও পড়ুন>>

হেনিংসেন এবং ওয়েওল উভয়েই মনে করেন, হুথি আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপশি আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর এই অঞ্চলেও উপস্থিতি বাড়ানো উচিত, যাতে জলদস্যুতার পুনরুত্থান না ঘটে।

সাগরে ফরাসি নৌবাহিনীর টহল। ফাইল ছবি: এএফপি

সাগরে ফরাসি নৌবাহিনীর টহল। ফাইল ছবি: এএফপি

দস্যুদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না কেন?
জাহাজের মালিকদের লুকআউট বা দ্রুতগতিতে ভ্রমণের মতো পরামর্শ দিয়ে থাকে আইএমবি, যাতে জলদস্যুরা তাদের ধরতে না পারে।

কিন্তু, জলদস্যুরাও ঝটিকা আক্রমণ চালায়। প্রায়ই রাতের অন্ধকারে হাজির হয় তারা। তাই, ক্রুরা ঘটনা বুঝে উঠতে উঠতেই দেরি হয়ে যায়।

একবার জলদস্যুরা কোনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে সামরিক পদক্ষেপ কঠিন হয়। কারণ, তাতে জিম্মিদের হতাহত হওয়ার শঙ্কা বাড়ে।

গভীর সমুদ্রে আটক জলদস্যুদের বিচারের মুখোমুখি করতে জটিলতার কারণে কখনো কখনো ছেড়েও দেওয়া হয়।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি রেজুলেশন রয়েছে, যাতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত দেশগুলোকে সোমালি জলসীমায় দস্যুদের ধরার অনুমতির কথা বলা রয়েছে।

মোকাবিলায় প্রতিবন্ধকতা
ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা বলছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের ভাষ্য, ওই এলাকায় নিয়োজিত অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় দস্যুবৃত্তির পুনরুত্থান ঠেকাতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এসব বাহিনীর সাফল্যও কম নয়। ইউরোপীয় নৌবাহিনীর পাশাপাশি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতি অনেক দস্যুতার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন>>

কিন্তু আইওসির অভিযোগ, ইইউন্যাভ বর্তমানে স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একটি মাত্র জাহাজ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ভারতীয় নৌবাহিনী ছাড়া জলদস্যুতা প্রতিরোধে সক্রিয় থাকা অন্য নৌবাহিনীগুলোর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা হয়েছে।

ওয়েওল বলেন, সোমালি দস্যুদের মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দুটি ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে নজর দিতে হবে।

প্রথমে তিনি হুথি বিদ্রোহীদের বক্তব্য উল্লেখ করেন। গোষ্ঠীটির বক্তব্য, তারা জাহাজে আক্রমণ বন্ধ করবে এবং সামুদ্রিক তৎপরতাও কমিয়ে আনবে, যদি ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করে।

দ্বিতীয়ত, নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করা সোমালিল্যান্ড এবং ইথিওপিয়ার মধ্যে একটি বিতর্কিত বন্দর চুক্তি হয়েছে, যা সোমালিয়াকে কূটনৈতিক টানাপোড়েনে ফেলে দিয়েছে। তাই, পরিস্থিতির অবনতি হলে জলদস্যুতা মোকাবিলা করা দেশটির জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।