কলকাতার প্রথম নারী বাসচালক

পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধি কলকাতা
প্রকাশিত: ০৩:৪৪ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২৪
কলকাতার প্রথম নারী বাসচালক প্রতিমা পোদ্দার

সমাজের সবক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তুলতে ও নারীদের নিজস্ব অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আর এবারের নারী দিবসে এমন এক ভারতীয় নারীর কথা জানাবো, যে কিনা নিজের সংসার চালাতে ধরেছেন মিনিবাসের স্টিয়ারিং।

উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বাসচালকের আসনে নারীদের সচরাচর দেখা যায় না। তবে কলকাতার পার্শ্ববর্তী জেলা উত্তর ২৪ পরগনার প্রতিমা পোদ্দার এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী।

উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মিনিবাসচালক শিবেশ্বর পোদ্দোর। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে চলতো তার। প্রথমদিকে তিনি নিজেই বাস চালাতেন ও মাসিক মাইনেতে একজন কন্ডাক্টর রেখেছিলেন। কিন্তু সহযোগীর মাইনে মিটিয়ে তার সংসার চলতো খুব কষ্টে করে। এরই মধ্যে ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাস চালানোর রুজি বন্ধ হতে বসে শিবেশ্বরের।

যৌথ পরিবারে দশ বছরের সংসারে আচমকাই তখন বিপর্যয়। প্রতিমা-শিবেশ্বরের দুই মেয়েই সে সময়ে একেবারে ছোট। একজনের বয়স নয়, অন্যজনের বয়স সবে দুই বছর। তাদের পড়াশোনার পথও বন্ধ হওয়ার মুখে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে শিবেশ্বর সিদ্ধান্ত নেন যে স্ত্রী প্রতিমা পোদ্দারকেও পেশাদার বাসচালক করে তুলবেন।

স্বামীর অনুপ্রেরণায় অর্থোপার্জনের হাল ধরলেন প্রতিমা। গাড়ি চালানো শেখার পরপরই কিছু দিন সল্টলেকে অ্যাম্বুল্যান্স চালান। একপর্যায়ে তার মনে হয়, অ্যাম্বুল্যান্সের চেয়ে বাস চালানোটাই সহজ। আর বাড়ির কাছেই বাস স্ট্যান্ড আছে। তার ওপরে ছোটবেলা থেকেই কাকা, ভাই ও পরে স্বামী, দেবরদের বাসচালক-কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করতে দেখেছেন।

পেশাটিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করায় বেশি ভাবেননি প্রতিমা। নিমতা-হাওড়া রুটে মিনিবাসের স্টেয়ারিং ধরেন। স্বামী তো বটেই, পাশে পান শাশুড়ি ও ননদকেও। সেই ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মিনিবাস নিয়ে দাপটে শহর ঘুরছেন মহানগরীর ‘ড্রাইভার দিদি’।

প্রায় দিনই ভোরের আলো না ফুটতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন উদ্যমী এই নারী। চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরে সংসারের দেখভাল। এরপরে ফের দ্বিতীয় দফায় বাসে ফেরা ও রাত পর্যন্ত নিরন্তর ডিউটি। দুর্ঘটনার জের সামলে উঠে স্বামী শিবেশ্বর এখন স্ত্রীর বাসে কন্ডাক্টরের ভূমিকায়। মাঝের সময়টুকুতে স্টিয়ারিংয়ের ধরেন শিবেশ্বর।

স্বামীকে পাশে পেয়ে প্রতিমারও ভরসা বেড়ে যায় অনেকখানি। শুধু তা-ই নয়। রাতের পথে বাস না পেয়ে অসহায় মানুষ কিংবা বয়স্ক যাত্রীদের কাছ থেকে জুটে যায় প্রশংসা, উৎসাহ, আশীর্বাদ আর সম্মান। সঙ্গে দুই মেয়ে আর শাশুড়ি-ননদের কাছ থেকে আসে পর্যাপ্ত সাহায্য।

তবে এই পথ যে খুব মসৃণ ছিল তা নয়। জন্য এখনো রাস্তাঘাটে অনেক ঠাট্টা-বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হয় প্রতীমাকে। তবে তিনি যেসব কথায় কর্ণপাত না করে নিজের ছন্দে মিনিবাস চালান। ভোর থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন এই পোদ্দার দম্পতি। বেলঘরিয়ার নিমতা থেকে হাওড়া রুটের বাস দিনে তিন থেকে চারটি ট্রিপ চালান তারা। গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও তেল খরচ বাদ দিয়ে তাদের আয় এখন মোটামুটি ভালোই হয়।

সময় পাল্টেছে আস্তে আস্তে। স্বামী সামলে উঠেছেন খানিকটা। মেয়েরাও বড় হয়ে একজন ক্লাস টেন, অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। পরিবারের শ্রী ফিরছে একটু একটু করে। আর কলকাতার মহিলা বাসচালকের পরিচিতিও বেড়েছে ক্রমশ। প্রতিমার ঝুলিতে এখন প্রচারের আলো, স্বীকৃতি, সম্মান সবই আছে।

স্বামী ভালবেসে গান শোনান স্ত্রীকে। সে গান প্রতিমার বড্ড পছন্দের। আর ভালবাসেন কবিতা। রবি ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কিংবা ‘হাট’ দিব্যি শুনিয়েও দিতে পারেন যখন খুশি। তবে কখন যেন স্টেয়ারিংটাই হয়ে গেছে ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিমা তাই ছুটে চলেছেন বাস নিয়ে।

এই নারী দিবসে সাফল্যের বহু কাহিনী শোনা যাচ্ছে। তবে পুরুষশাসিত এই সমাজে এমন একটি পেশায় প্রতিমা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা পশ্চিমবঙ্গের সব নারীর জন্য দৃষ্টান্তমূলক। চাইলে নারীরাও যে পুরুষশাসিত পেশাগুলোতে সাবলিলভাবে কাজ করতে পারেন, তা যেন হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন এই নারী।

ডিডি/এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।