ইরান-পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক শক্তিতে এগিয়ে কে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ২০ জানুয়ারি ২০২৪
ছবি সংগৃহীত

বিশ্ব যখন ইসরায়েল-গাজা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উত্তপ্ত ঠিক সে সময়ই নতুন করে ইরান-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটলো। গত মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) রাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের সীমান্তবর্তী একটি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইরান। ইরানের দাবি, পাকিস্তানভিত্তিক সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী জাইশ আল-আদলকে লক্ষ্য করেই তারা ওই হামলা চালিয়েছে। এই গোষ্ঠীটি পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে সক্রিয়, যারা সবসময় ইরান সরকারের বিরোধিতা করে আসছে।

জাইশ আল-আদলের অর্থ হচ্ছে ন্যায়বিচার ও সমতার পক্ষে যোদ্ধা। এরা নিজেদেরকে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে সুন্নি অধিকার রক্ষক হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। গত কয়েকদিনে তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরানের হামলার শিকার হলো পাকিস্তান। এর আগে ইরান সোমবার ইরাকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদরদপ্তর এবং সিরিয়ায় আইএস-এর ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

আরও পড়ুন: পাকিস্তান-ইরানের মধ্যে উত্তেজনা কমার ইঙ্গিত

তবে ওই হামলার দুদিন পর নিজেদের ভূ-খণ্ডে ইরানের হামলার বিপরীতে দেশটিতে প্রতিশোধমূলক পাল্টা রকেট ও ড্রোন হামলা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। বৃহস্পতিবার ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানা লক্ষ্য করে চালানো হামলায় বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে দেশটি।

এই দুই দেশের সীমান্তে বহু বছর ধরে এ ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের এমন উত্তাল অবস্থার মাঝে এরা নিজেদের মাঝে আবার কোনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কি না। আর যদি এরা নিজেদের মাঝে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয় সেক্ষেত্রে সামরিক শক্তির দিক থেকে কোন দেশ কতটা এগিয়ে?

পশ্চিমা বিশ্ব মনে করে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ইরান অনেক এগিয়ে। এমনকি দেশটির যুদ্ধ সরঞ্জাম চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তাদের ধারণা। এদিকে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২৪ সালের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, সামরিক শক্তির দিক থেকে বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের স্থান নবম। অন্যদিকে ইরানের অবস্থান ১৪তম।

৬০টির বেশি উপাদান নিয়ে এই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। এতে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, স্থানীয় শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ, কর্মক্ষমতা এবং প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্বের দেশের মর্যাদার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

সৈন্য সংখ্যা
সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে ইরানের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে পাকিস্তান। দেশটির সামরিক বাহিনীর সর্বমোট সদস্য হলো ১৭ লাখ। এর মাঝে সক্রিয় সেনা সদস্য সাড়ে ছয় লাখ এবং রিজার্ভে আছে সাড়ে পাঁচ লাখ। এছাড়া আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য আছে পাঁচ লাখ।

অন্যদিকে ইরানের সামরিক বাহিনীর সদস্য হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ। এর মাঝে সক্রিয় আছে ছয় লাখ ১০ হাজার এবং রিজার্ভে আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য দুই লাখের বেশি।

প্রতিরক্ষা বাজেট
ইরান ও পাকিস্তান এই দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটে বড় পার্থক্য রয়েছে। ইরানের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট ৯৯৫ কোটি ৪৪ লাখ ৫১ হাজার ডলার। এই র‍্যাংকিংয়ের দেশগুলোর মাঝে দেশটি ৩৩তম অবস্থানে রয়েছে।

অন্যদিকে জনসংখ্যার দিক থেকে প্রথম সারির হলেও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ রয়েছে ৬৩৪ কোটি ৯৮ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮৯ ডলার। এক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান ৪৭তম।

যুদ্ধ বিমানের সংখ্যা
ইরানের মোট সামরিক বিমান রয়েছে ৫৫১টি আর পাকিস্তানের রয়েছে এক হাজার ৪৩৪টি বিমান। কিন্তু এসবের মধ্যে শুধু যু্দ্ধবিমান ইরানের রয়েছে ১৮৬টি। অন্যদিকে পাকিস্তানের আছে ৩৮৭টি। ইরানের আক্রমণকারী বা অ্যাটাকিং বিমান রয়েছে ২৩টি। অন্যদিকে পাকিস্তানের আছে ৯০টি। তবে পরিবহনের জন্য ইরানের বিমান সংখ্যা বেশি। তাদের রয়েছে ৮৬টি বিমান। কিন্তু পাকিস্তানের আছে ৬০টি।

হেলিকপ্টার
দুই দেশের সামরিক বাহিনীর কাছেই সাধারণ হেলিকপ্টার রয়েছে। এর মাঝে ইরানের আছে ১২৯টি। কিন্তু পাকিস্তানের কাছে তিনগুণ বেশি অর্থাৎ ৩৫২টি বিমান। আক্রমণকারী বা অ্যাটাকিং হেলিকপ্টারের দিক থেকেও পিছিয়ে ইরান। দেশটির মোট আক্রমণকারী হেলিকপ্টার রয়েছে ১৩টি যেখানে পাকিস্তানের রয়েছে ৫৭টি।

ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া যান
পাকিস্তানের মোট ট্যাঙ্কের সংখ্যা ৩ হাজার ৭৪২টি। ইরানের রয়েছে এক হাজার ৯৯৬টি। এরকম বাহন ইরানের রয়েছে ৬৫ হাজার ৭৬৫টি এবং পাকিস্তানের ৫০ হাজার ৫২৩টি।

আর্টিলারি
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তালিকায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের দিক বিবেচনায় পাকিস্তান অনেকটা এগিয়ে। ইরানের সেলফ-প্রোপেলড আর্টিলারি আছে ৫৮০টি, পাকিস্তানের ৭৫২টি। ইরানের টাওড আর্টিলারি (টেনে নিয়ে যাওয়ার কামান) আছে দুই হাজার ৫০টি, পাকিস্তানের তিন হাজার ২৩৮টি। তবে ইরানের রকেট আর্টিলারি ৭৭৫ টি থাকলেও পাকিস্তানের আছে মাত্র ৬০২টি।

নৌবাহিনীর সরঞ্জাম
ইরানের নৌবাহিনীর কাছে মোট ১০১টি যুদ্ধযান রয়েছে। আর পাকিস্তানের আছে ১১৪টি। ইরানের ফ্রিগেট (দ্রুতগামী মাঝারি যুদ্ধজাহাজ) রয়েছে সাতটি, পাকিস্তানের নয়টি। ইরানের কর্ভেট (ছোট আকারের যুদ্ধজাহাজ) আছে তিনটি, পাকিস্তানের সাতটি।

ইরানের সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ আছে ১৯টি কিন্তু পাকিস্তানের আছে আটটি। ইরানের প্যাট্রোল নৌযান (টহল জাহাজ) আছে ২১টি, পাকিস্তানের আছে ৬৯টি। ইরানের কোনও ডেস্ট্রয়ার না থাকলেও পাকিস্তানের দুইটি ডেস্ট্রয়ার রয়েছে।

ইরানের মাইন যুদ্ধজাহাজ রয়েছে একটি, পাকিস্তানের আছে তিনটি। এসব যুদ্ধযানের মধ্যে ইরান ও পাকিস্তান কারও কোনো বিমানবাহী রণতরী নেই।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, সামরিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এরপরেই রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, তুরস্ক, ও ইতালি।

পারমাণবিক শক্তি কার আছে?
সুইডেন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শুরুতে বিশ্বের ৯টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫১২টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। দেশগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েল। এই তালিকায় পাকিস্তানের নাম থাকলেও ইরানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র কখনোই ছিলো না।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার দাবী করেছে যে, ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের মজুদ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। এদিকে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেনি যে কোন দেশের হাতে কতটি এ ধরণের অস্ত্র রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতার বিষয়টি তারা তাদের রিপোর্টে বিবেচনায় নেয়নি।

আরও পড়ুন: ইরান-পাকিস্তান সংঘাত কি যুদ্ধে রূপ নেবে?

সামরিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলে থাকেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনেকটা ডেটেরেন্ট বা নিবৃত্তকরণের উপাদান হিসেবে কাজ করে, কারণ শেষ পর্যন্ত এ ধরণের অস্ত্র কেউ ব্যবহার করতে চাইবে না।

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।