অ্যাপোলোর কিডনি চোরাকারবারের তদন্ত করবে দিল্লি
সম্প্রতি ভারতের শীর্ষ ও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি হাসপাতালের গ্রুপ অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে কিডনি পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ। একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তারা বলেছিল, হাসপাতালটি বিপুল অর্থের বিনিময়ে মিয়ানমারের দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে যুক্তরাজ্যসহ সারাবিশ্বের ধনীদের জন্য কিডনির ব্যবস্থা করছে।
এমন অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাপোলো গ্রুপের পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ইন্দ্রপ্রস্থ মেডিকেল করপোরেশন লিমিটেড (আইএমসিএল) এই খবরকে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বলে দাবি করে। তবে বিষয়টি আমলে নিয়ে এর যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বুধবার (৬ ডিসেম্বর) ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান দ্য ন্যাশনাল অর্গান অ্যান্ড টিস্যু ট্রান্সপ্ল্যান্ট অর্গানাইজেশন (নটো) দিল্লি রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এস বি দীপক কুমার বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
চিঠিতে দ্য টেলিগ্রাফের অভিযোগ তদন্তের পাশপাশি যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া ও তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দিল্লির স্বাস্থ্য সচিবকে। আর সেই প্রতিবেদন দিতে হবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে।
রোববার (৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, কিডনি-বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে দিল্লির অ্যাপোলো হসপিটালের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ তোলে দ্য টেলিগ্রাফ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের কিডনি কেনা-বেচা অবৈধ। তবু বেআইনিভাবে মিয়ানমারের দুস্থ মানুষদের কাছ থেকে কিডনি কিনে ধনীদের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করছে নামকরা এই হাসপাতালটি।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে প্রতি বছর ১ হাজার ২০০টিরও বেশি কিডনি কেনাবেচা হয়। পাশপাশি সেখান থেকে চোরাই পথে ভারতের বাইরে, এমনকি, যুক্তরাজ্যেও কিডনি পাঠানো হয়।
এসব কিডনি মূলত সংগ্রহ করা হয় মিয়ানমারের দরিদ্র লোকজনের শরীর থেকে। প্রতিটি কিডনির জন্য ডোনার বা দাতাকে দেওয়া হয় ৮০ থেকে ৯০ লাখ রুপি, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ৫ লাখ ৫৭ হাজার থেকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।
আর এ কাজের জন্য দালাল বা এজেন্টের মাধ্যমে অর্থের লোভ দেখিয়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তরুণ-তরুণীদের দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়। তারপর অ্যাপোলো বা এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত কোনো হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশনের মাধ্যমে কিডনি সংগ্রহ করা হয়।
এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত একজন দালালের সঙ্গে কথা হয় টেলিগ্রাফের। তিনি বলেন, কিডনির এই ব্যবসার ব্যপ্তি বিশাল বড়। কিডনিদাতাদের আনা-নেওয়ার জন্য দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ দেওয়া হয়।
মিয়ানমারের এসব দরিদ্র মানুষদের কিডনি কেনেন বড়লোক ক্রেতারা। এসব ক্রেতাদের মধ্যে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ধনী বার্মিজরাও রয়েছেন।
টেলিগ্রাফে উঠে এসেছে ৫৮ বছর বয়সী বার্মিজ নারী দাও সোয়ে সোয়ে নামের এক ক্রেতার কথা। যুক্তরাজ্য প্রবাসী দাও সোয়ে সোয়ে প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লির আইসিএমএল হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে নিজের শরীরে নতুন কিডনি প্রতিস্থাপন করেন তিনি। কিডনি কেনা বাবদ সেসময় ডোনারকে এই নারী ৩১ হাজার ইউরো, বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
অবাক করার বিষয় হলো, এ ব্যবসার সঙ্গে ভারতের অন্যতম শীর্ষ চিকিৎসক ও সার্জন ডা. সন্দ্বীপ গুলেরিয়ার সংশ্লিষ্টতার তথ্যও পাওয়া গেছে। টেলিগ্রাফ বলছে, ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ অর্জন করা এই চিকিৎসক কিডনি প্রতিস্থাপনসংক্রান্ত অনেকগুলো অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ডা. সন্দ্বীপ গুলেরিয়া অবশ্য এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, তার পর্যায়ের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আনা হাস্যকর ও আক্রমণাত্মক।
তবে ডা. গুলেরিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ২০১৬ সালে ভারতের সংবাদমাধ্যম ডেকান হেরাল্ড তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছিল। এবং সেই সময়েও এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক চোরাকারবারগুলোর একটি। যুক্তরাজ্যের সেন্ট মেরি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি, বিশ্বে প্রতি ১০টি প্রতিস্থাপিত অঙ্গের একটি চোরাই পথে আসছে।
সূত্র: রয়টার্স, দ্য টেলিগ্রাফ
এসএএইচ