তুরস্ক-ভারতের সম্পর্ক তলানিতে কেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:২৮ পিএম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ফাইল ছবি

চলতি মাসের শুরুতে দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যে বিশ্বনেতারা ভারতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানও ছিলেন। সম্মেলনের অবকাশে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর ‘দক্ষিণ এশিয়াতে তুরস্কের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার’ ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি।

দিল্লিতে এরদোয়ান ও মোদী যখন করমর্দন করে আলোকচিত্রীদের সামনে ‘পোজ’ দিচ্ছেন, তার ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগেই দিল্লিতে ঘোষিত হয়েছে ‘ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ’ অর্থনৈতিক করিডর বা আইএমইসি-র রূপরেখা।

আরও পড়ুন>যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের পরীক্ষা নিচ্ছে ভারত

এতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস ও সেই সঙ্গে আমিরাত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি ছিল।

সেখানে জানানো হয়, নৌপথে ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে শুরু করে তারপর রেলে আমিরাত, সৌদি, জর্ডান ও ইসরায়েল হয়ে আবার সমুদ্রপথে এই করিডর কীভাবে ইউরোপের বন্দরে গিয়ে ভিড়বে।

এই করিডরের ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হয়েছিল যেসব দেশ, তার অন্যতম হচ্ছে তুরস্ক।

তুরস্ক থেকে যে সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হয়ে দিল্লিতে এসেছিলেন, পরদিন তাদেরকে এরদোয়ান সাফ জানিয়ে দেন, তুরস্ককে পাশ কাটিয়ে এরকম কোনো করিডর তৈরির চেষ্টা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না।

পূর্বের এশিয়া থেকে পশ্চিমে ইউরোপের মাঝে কোনো ‘ট্র্যাফিক’ (পণ্য চলাচল) গেলে তা তুরস্কের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, আঙ্কারার এই অবস্থানের কথাও খুব স্পষ্ট ভাবেই সেদিন ঘোষণা করেন তিনি।

আরও পড়ুন>ইসরায়েলি কোনো মন্ত্রীর প্রথম সৌদি সফর

এরপর দেশে ফিরে কয়েকদিনের মধ্যেই এরদোয়ান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে যান এবং সেখানে বিগত কয়েক বছরের মতো আবারও কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন।

ভারতও যথারীতি সে বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে জানায়, কাশ্মীর প্রশ্নে তিনি স্রেফ পাকিস্তানের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করছেন। যাকে কোনো গুরুত্ব দেওয়ারই দরকার নেই।

এরই মধ্যে দিল্লির ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকা রিপোর্ট করে, দিল্লি সফরের সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট শহরের বিখ্যাত জামে মসজিদে গিয়ে শাহী ইমামের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারত সরকার তার সেই অনুরোধ খারিজ করে দেয়।

ফলে তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে বলে কিছুদিন আগেও যে ধারণা তৈরি হচ্ছিল তা ধূলিসাৎ হতেও সময় লাগেনি।

বস্তুত এই মুহুর্তে দু’দেশের সম্পর্ক যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পর্যবেক্ষকরা আরও বলছেন, ইসরায়েল, গ্রিস, সাইপ্রাস বা আর্মেনিয়ার মতো তুরস্কের যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক খুব খারাপ, ঠিক তাদের সঙ্গেই ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা এ সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো কাশ্মীর।

বস্তুত ইসলামি বিশ্বে তুরস্কের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য এরদোয়ান সাম্প্রতিককালে যেভাবে কাশ্মীর ইস্যুটিকে ব্যবহার করেছেন তেমনটা আর কেউই করেননি।

আরও পড়ুন>ভারতকে ‘প্রকাশ্যে ও গোপনে’ তদন্তে সাহায্য করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র

গত সাত-আট বছর ধরে তিনি নিয়ম করে কাশ্মীরে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তুলে আসছেন, তার সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদেও বিষয়টি বারবার উত্থাপন করেছে।

অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ কবীর তানেজা বলছিলেন, মনে রাখতে হবে কাশ্মীরে ভারত ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর যে মুসলিম দেশটি পাকিস্তানের সুরে সুর মিলিয়ে সেই পদক্ষেপের নিন্দা করেছিল সেটি হলো তুরস্ক।

এর আগে ২০১৯-এ জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে এরদোয়ান ‘কাশ্মীর কনফ্লিক্ট’কে সাত দশক ধরে ভুলে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও তীব্র ভাষায় দায়ী করেছিলেন।

কবীর তানেজা আরও জানিয়েছেন, কাশ্মীর ইস্যুটিকে উপেক্ষা করার জন্য এরদোয়ান কিন্তু ইসলামিক দেশগুলোর জোট ওআইসি ও সৌদি আরবেরও সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি।

অন্য দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কর ‘মিত্রতা’র সম্পর্কও ঐতিহাসিক। বস্তুত এরদোয়ান হলেন একমাত্র বিশ্বনেতা যিনি পাকিস্তানে পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে চার চারবার ভাষণ দিয়েছেন, দুইবার প্রধানমন্ত্রী ও দুইবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

বিশ্লেষকরা বলেন, অটোমান সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার বা ‘নিও-অটোমানাইজেশনে’র মাধ্যমে এরদোয়ান যেভাবে তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা দিতে চান, তার সেই প্রচেষ্টায় পাকিস্তান খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

ফলে কাশ্মীর প্রশ্নে কেন এরদোয়ান পাকিস্তানের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে চলেছেন, তা অনুমান করা শক্ত নয়।

অন্যদিকে, বিগত প্রায় এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতে একটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আছে, যারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘নিউ ইন্ডিয়া’ বা ‘নতুন ভারতে’র আবির্ভাব ঘোষণা করতে চাইছে।

এই ‘নতুন ভারত’কে আন্তর্জাতিক বিশ্ব অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে ‘নিয়ন্ত্রণে আনতে পারা’টা সেই সাফল্যের একটা বড় কারণ বলে নিউ ইন্ডিয়ার কর্ণধাররা হামেশাই দাবি করে থাকেন।

অর্থাৎ একই কাশ্মীরকে ভারত ও তুরস্ক সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দুটি কারণে বিশ্বমঞ্চে ব্যবহার করতে চাইছে। আর সেটাই দু’দেশের মধ্যে তিক্ততার একটা প্রধান কারণ।

লক্ষ্যণীয়ভাবে, সাম্প্রতিককালে তুরস্কের প্রতিবেশী বা কাছেপিঠে এমন একাধিক দেশের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নিয়েছে, যাদের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক রীতিমতো খারাপ।

এর মধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বেশ কিছুটা পুরনো হলেও গ্রিস, সাইপ্রাস বা আর্মেনিয়ার সঙ্গে বেশ হালেই ভারত সম্পর্ক উন্নয়ন করার ব্যাপারে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।

গত মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে দেশে ফেরার পথে নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রীয় সফরে গ্রিসে গিয়েছিলেন। ওই সফর ছিল সে দেশে ৪০ বছরের মধ্যে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর।

সেই সফরের মাত্র দিন পনেরোর মধ্যেই দিল্লিতে আইএমইসি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়, যে করিডরের ইউরোপ প্রান্তে গ্রিস একটি গুরুত্বপূর্ণ হাব।

তুরস্ককে উপেক্ষা করে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিসকে যেভাবে ওই করিডরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এরদোয়ান এরইমধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেটা তিনি মানতে পারছেন না।

অন্যদিকে গ্রীস যেমন ভারতকে কাশ্মীর প্রশ্নে সমর্থন করছে, তেমনি ভারতও সাইপ্রাস ইস্যুতে গ্রিসকে সমর্থন জানাচ্ছে।

আর্মেনিয়াতে ১৯১৫ সালে সংঘটিত জেনোসাইড বা গণহত্যাকে কেন্দ্র করে তুরস্কের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে, সেই আর্মেনিয়াতেও জি-টু-জি বা সরকারি পর্যায়ে করা চুক্তির আওতায় ভারত সম্প্রতি অস্ত্র রপ্তানির পদক্ষেপ নিয়েছে।

ইস্তাম্বুলের সিনিয়র সাংবাদিক বেকির সিটকি সিরিন মনে করেন, এই সব কারণেই ভারতের এই নতুন নতুন ‘ডিপ্লোম্যাটিক আউটরিচ’ গুলোকে তুরস্ক খুব একটা ভালো নজরে দেখছে না।

তিনি বলেছেন, তুরস্কের একটা সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে তাদের ভৌগোলিক অঞ্চলে ভারত নিজস্ব প্রভাব বাড়িয়ে তাদের বিরক্ত করতে চাইছে।

তাছাড়া আগামী বছরের গোড়ায় গ্রিস-ইসরায়েল-সাইপ্রাস ও সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত ‘থ্রি প্লাস ওয়ান’ গ্রুপিংয়ের সম্মেলনেও ভারতকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই পদক্ষেপেও তুরস্ক যথারীতি খুশি নয়।

বিগত সাড়ে নয় বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে নরেন্দ্র মোদী একটিবারের জন্যও কোনো দ্বিপাক্ষিক সফরে তুরস্কতে যাননি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি একবারই তুরস্কে গিয়েছিলেন। সেটা ২০১৫ সালে বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম জি২০-র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। অন্যদিকে এরদোয়ানও এই সময়কালে মাত্র একবারই ভারতে যান।

কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের ঘোষিত অবস্থান হলো, ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি অনুসারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিকভাবেই এর মীমাংসা হতে হবে। অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ এর মধ্যে ঢুকতে পারবে না।

এরদোয়ান সেই বিরোধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে ভারতকে চটিয়ে দিয়েছিলেন। যে সম্পর্ক আজ পর্যন্ত স্বাভাবিক তো হয়ইনি, বরং দু’পক্ষের মধ্যে তিক্ততা ক্রমশ বেড়েছে।

তুরস্কের সাংবাদিক বেকির সিটকি সিরিন কিন্তু বলছেন, কাশ্মীরের মতো সংবেদনশীল ইস্যুতেও একটা মাঝামাঝি রাস্তা নেওয়ার অবকাশ আছে বলে মি. এরদোয়ান এখনও বিশ্বাস করেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।