হাতের ছোঁয়া ছাড়াই টমেটো চাষ, তাক লাগালো ডাচ প্রযুক্তি
প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সবজি চাষ হয় নেদারল্যান্ডসে। তা রপ্তানি হয় ইউরোপসহ গোটা বিশ্বেই। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে ছোট্ট এই দেশটিই আজ হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক। বর্তমানে ইউরোপে মাংসের প্রধান জোগানদাতা, বিশ্বজুড়ে ফুল-সবজি বীজের অন্যতম বড় সরবরাহকারী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছে ডাচরা। কিন্তু ষাটের দশকে বিশ্ব মানচিত্রে তাদের পরিচিতি এনে দিয়েছিল মূলত একটি পণ্য- টমেটো।
নেদারল্যান্ডসের গ্রিনহাউজগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ টন টমেটো উৎপাদন হয়। বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের টমেটো রপ্তানি করে দেশটি। আর এসবই সম্ভব হয়েছে কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে।
বিশ্বজুড়ে ইনডোর ফার্ম বা গ্রিনহাউজ তৈরি করে থাকে ডাচ কোম্পানি প্ল্যান্টল্যাব। প্রকৃতির প্রতিকূল রূপ যেন ফসলের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে না পারে, সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কোম্পানিটি। প্ল্যান্টল্যাবের প্রধান নির্বাহী ইলকো ওকার্সের কথায়, আমাদের বিশ্বাস, আমরা প্রকৃতির চেয়েও ভালো করতে পারি।
আরও পড়ুন>> প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিকে যেভাবে বদলে দিচ্ছে নেদারল্যান্ডস
২০০৮ সালে ওকার্সসহ তিন উদ্যোক্তা মিলে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছিলেন ইনডোর কৃষি। এর দু’বছর পরেই, ২০১০ সালে নিজস্ব কোম্পানি চালু করেন তারা। এলইডি লাইট ব্যবহার করে ডাচ গ্রিনহাউজ এবং ইনডোর কৃষকদের ফলন বাড়াতে সাহায্য করতে শুরু করে কোম্পানিটি।
প্ল্যান্টল্যাব এমন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে মাত্র দুটি ফুটবল মাঠের সমান জমিতে এক লাখ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সবজি (জনপ্রতি প্রায় আধা পাউন্ড) উৎপাদন করা যায়।
নেই হাতের ছোঁয়া
নেদারল্যান্ডসের ডেন বোশ শহরে প্ল্যান্টল্যাবের যে গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে, সেটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভার্টিকাল খামার। এখানে সীমিত আলোর এলইডি বাল্ব ও প্লাস্টিকের তৈরি প্রোডাকশন ট্রে ব্যবহার করা হয়। পানিতে শিকড় ছুঁয়ে থাকা গাছপালা জন্মায় ভার্মিকুলাইটের ওপর।
প্ল্যান্টল্যাব প্রধান বলেন, এখানে কোনো কিছুতে হাতের ছোঁয়া লাগে না। পানি পুনঃসঞ্চালন করা হয়। অর্থাৎ, চাষ প্রক্রিয়ার কোথাও পানি নষ্ট হয় না।
নেদারল্যান্ডসের বাইরে আরও উৎপাদনকেন্দ্র খোলার জন্য এ বছরের শুরুতে পাঁচ কোটি ইউরো বিনিয়োগ পেয়েছে প্ল্যান্টল্যাব। এসব খামারে কীটনাশক বা ভেষজনাশক ছাড়াই বিপুল পরিমাণে শাকসবজি চাষ করা হবে।
আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় নিজেদের কার্যক্রম আরও ছড়িয়ে দিতে চায় ডাচ কোম্পানিটি। আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ২৫০ একর জমিতে ভার্টিকাল খামার গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে তারা।
কাচের ঘরে কৃষি বিপ্লব
রটারড্যামের কাছাকাছি একটি শহর ওয়েস্টল্যান্ড। বর্তমানে এই শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতেই রয়েছে কাচে ঘেরা গ্রিনহাউজ।
১৯৯৭ সালে ওয়েস্টল্যান্ড থেকে দক্ষিণে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে ‘অ্যাগ্রো কেয়ার’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেন ডাচ উদ্যোক্তা কিস ভ্যান ভিন ও তার বন্ধু ফিলিপ ভ্যান এন্টওয়ার্পেন। ২৫ বছর পর আজ ৬৪৫ একর জমিতে গ্রিনহাউজের ভেতর টমেটো চাষ করছেন তারা এবং এতে সাহায্য করছেন দেড় হাজার কর্মী। ২০৩০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ দ্বিগুণ করতে চায় অ্যাগ্রো কেয়ার।
ছোট ব্যাগে টমেটোর চাষ
অ্যাগ্রো কেয়ারের খামারগুলোতে রকউলের ছোট ছোট ব্যাগে টমেটো গাছ লাগানো হয়। এ পদ্ধতিতে পানির মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে গাছগুলো।
অতীতে নেদারল্যান্ডসের টমেটো মানেই শক্ত, স্বাদবিহীন ও সবুজ রঙের বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু এই দুর্নাম দূর করতে বড় ভূমিকা রেখেছে অ্যাগ্রো কেয়ার। ২০০০ সালে টমেটোর ওপর আলো ফেলে এবং ডালে রেখেই পুরোপুরি পাকানোর পদ্ধতিতে চাষ শুরু করে কোম্পানিটি।
আরও পড়ুন>> শস্য না খাইয়ে যেভাবে মুরগি পালন করছে নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি
এই পদ্ধতিতে বিপুল বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োজন হয়। এ কারণে অ্যাগ্রো কেয়ার নিজেরাই ছোটখাটো একটি বৈদ্যুতিক কোম্পানি চালু করেছে। এতে তৈরি হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড পাইপের মাধ্যমে গ্রিনহাউজের ভেতর ছাড়া হয়। সেই গ্যাস কাজে লাগিয়ে গাছগুলো পুষ্টি সংগ্রহের পাশাপাশি অক্সিজেন সরবরাহ করে। এই পদ্ধতি ৯৯ শতাংশ কার্যকর এবং এর মাধ্যমে বাতাসে অনেক কম কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া হয়।
এরই মধ্যে ইউরোপের বৃহত্তম টমেটো উৎপাদনকারীদের একটিতে পরিণত হয়েছে অ্যাগ্রো কেয়ার। বছরে প্রায় ১০ কোটি কিলোগ্রাম টমেটো উৎপাদন করে তারা। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের বাইরে মরক্কো এবং তিউনিসিয়াতে খামার চালু করেছে কোম্পানিটি।
বর্তমানে তাদের চাষ করা টমেটোর মাত্র এক-চতুর্থাংশ নেদারল্যান্ডসে ব্যবহৃত হয়, বাকিটা ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট
কেএএ/