ভারতীয় অভিবাসীদের ওপর কি আদৌ কানাডা-ভারত দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়বে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৪৪ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

কানাডা ও ভারতের চলমান কূটনৈতিক বিবাদের মধ্যেই কানাডায় বসবাসকারী ভারতীয়দের সতর্ক থাকার উপদেশ দিয়েছে দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। এর আগে কানাডাও তাদের নাগরিকদের ভারত ভ্রমণের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল, কিন্তু সেটাকে পূর্ব পরিকল্পিত ও সাম্প্রতিক কূটনৈতিক বিবাদের জের নয় বলেই দাবি করেছে অটোয়া।

দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, কানাডায় ক্রমবর্ধমান ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ ও রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাওয়া ঘৃণামূলক অপরাধ ও সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে কানাডায় বসবাসকারী ভারতীয়দের এই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। উত্তর আমেরিকার দেশটির যেসব অঞ্চলে সহিংসতা ঘটছে, সেইসব জায়গা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: কানাডায় শিখ নেতাকে হত্যার ঘটনায় ভারতকে জড়ালেন ট্রুডো

দিল্লির ওই ‘ট্র্যাভেল অ্যাডভাইসরি’ জারি করার আগে কানাডাও তার নাগরিকদের ভারত ভ্রমণের ‘ট্র্যাভেল অ্যাডভাইসরি’ হালনাগাদ করে। তবে কানাডা সরকারি মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, এই সতর্কতা পূর্ব পরিকল্পিত ও তারা সাম্প্রতিক বিবাদের কারণে বাড়তি কোনো সতর্কতা জারি করেনি।

jagonews24

দুই মিত্র দেশের মধ্যে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয় গত সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর), যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সে দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেন, খালিস্তানপন্থী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনায় ভারতের সরকারি এজেন্সিগুলোর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এরই মধ্যে ভারত-কানাডা দুই দেশই একে অপরের একজন শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।

বিশ্বের নজর এখন এই বিবাদের দিকে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কানাডায় বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্যও উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। বিশেষ করে, ভারতীয় শিক্ষার্থীরা, যারা উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডার বিভিন্ন প্রদেশে বসবাস করছেন। পাশাপাশি যেসব ভারতীয়রা এখন কানাডার কর্মশক্তির একটি সক্রিয় অংশ হয়ে উঠেছেন, তাদের নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অনেকে।

কানাডায় বসবাসকারী অভিবাসীদের ১৮ শতাংশই ভারতীয়

গত বছর কানাডিয়ান সরকার আদমশুমারির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা গেছে, অন্যান্য দেশ থেকে আসা মোট অভিবাসীর ১৮ দশমিক ৬ শতাংশই ভারতীয়। টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পর কানাডাতেই শিখ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তারা সেখানকার মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১ শতাংশ।

শুধু তাই নয়, ২০১৮ সাল থেকে কানাডায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী যায় ভারত থেকে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে কানাডায় অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশই ভারতীয়।

jagonews24

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গত বছর কানাডার আদমশুমারির ফলাফল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়, কানাডার টরন্টো, অটোয়া, ওয়াটারলু ও ব্র্যাম্পটন শহরে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় প্রবাসী বসতি স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে টরন্টো ভারতীয়দের জন্য একটি শক্ত ঘাঁটির মতো। শহরটি কানাডার উন্নয়নের দিক থেকে শীর্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়।

এগুলো ছাড়াও, ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ভালো সংখ্যক ভারতীয় রয়েছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের একটি গুরুদুয়ারেই (শিখদের সমাবেশ ও প্রার্থনার স্থান) হরদীপ সিং নিজ্জারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

কানাডার অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয়রা

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রোর মতো ৩০টি ভারতীয় সংস্থা কানাডায় কয়েক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।

হত্যার ঠিক এক মাস আগে হরদীপ সিং নিজ্জারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কানাডায় বসবাসরত প্রবীণ সাংবাদিক গুরপ্রীত সিং। তিনি বলছেন, ভারত-কানাডার সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বের ফলে ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন: কানাডীয়দের ভিসা দেওয়া বন্ধ করলো ভারত

তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে কানাডায় থাকা ভারতীয়দের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক অভিবাসন নীতির উপরে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত তারা। দুই দেশের ভিসা নেওয়ার ব্যবস্থা বা ব্যবসা বাণিজ্য কতটা প্রভাবিত হবে সেটাও ভাবছেন ভারতীয়রা। একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

ভারতীয় অভিবাসীদের নানা মত

ফোর্বস এ বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে ২০১৩ সালের পর থেকে কানাডায় ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। কানাডায় বসবাসরত ভারতীয়দের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। আবার এমন শিক্ষার্থীরাও আছেন, যারা আগামী বছরগুলোতে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লাইভমিন্ট অবশ্য তাদের এক প্রতিবেদনে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি কানাডায় বসবাসরত ভারতীয় বা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে হচ্ছে না। এর পিছনে যুক্তি হলো, বর্তমানে কানাডিয়ান প্রশাসন বা ইমিগ্রেশন সার্ভিসের কাছ থেকে এমন কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি, যা ভারতীয় প্রবাসীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে।

আরও পড়ুন: ভারত-কানাডা বিরোধ নিয়ে শঙ্কায় পশ্চিমারাও

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কিছু কনসাল্টেন্সি সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছে, যারা ভারতীয়দের ভিসা পেতে সহায়তা দিয়ে থাকে। তারা যুক্তি দিচ্ছে, কানাডায় অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশ ভারতীয়। কানাডা এদের থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়, তাই তারা কোনো ধরনের ঝুঁকি নেবে না।

সাংবাদিক গুরপ্রীত সিং বলেন, পুরো বিষয় নিয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে দুই রকম মতামত রয়েছে। কারও কাছে এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্সিগুলির সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। আবার এমন একটি অংশও রয়েছে, যারা খালিস্তানি ধারণার সঙ্গে একমত নয়। তারা মনে করেন, ট্রুডোর ওই বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজনই ছিল না।

সম্পর্কের অবনতি মেরামতে সময় লাগবে

কানাডার আদমশুমারির তথ্য থেকে আরও দেখা যায়, পাঞ্জাবি ছাড়াও কানাডায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ রয়েছেন, যাদের মাতৃভাষা তামিল, হিন্দি, গুজরাটি, মালায়ালাম ও তেলেগু। আদমশুমারি অনুসারে, হিন্দুরা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা শিখদের চেয়ে সামান্য বেশি।

হরদীপ সিং নিজ্জারের মৃত্যুর পর কানাডায় অনেক হিন্দু মন্দিরে হামলার খবর পাওয়া যায়। পুরো বিষয়ে কানাডিয়ান হিন্দুদের অবস্থান প্রসঙ্গে গুরপ্রীত সিং বলেন, শিখদের মতো হিন্দু সম্প্রদায়েরও ভিন্ন মত রয়েছে। শিখদের একটি অংশ খালিস্তানের পক্ষে, অন্য একটি অংশ বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন কানাডায় এসেছিলেন, তখন তাকে এখানকার প্রাচীনতম গুরুদুয়ারেই স্বাগত জানানো হয়েছিল।

jagonews24

একইভাবে, হিন্দুদের একটি অংশ রয়েছে, যাদের আরএসএস মতাদর্শের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তারা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত চায়। কিন্তু যেভাবে মেরুকরণের পরিবেশ বাড়ছে, তা উদ্বেগের বিষয়।

ভারতে খালিস্তানের দাবী তুঙ্গে ছিল ১৯৮০’র দশকে। কিন্তু কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে শিখ সম্প্রদায়ের একটি অংশ এখনো সেই দাবির পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: ‘বন্ধু থেকে শত্রু’, নেপথ্যে কি শুধুই শিখ নেতার হত্যাকাণ্ড?

এই দেশগুলোকে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে আসছে ভারত। এমনকি, জাস্টিন ট্রুডো যখন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন, তখনও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার কাছে খালিস্তানের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন।

এবিসি নিউজের মতে, কানাডার আন্তর্জাতিক বিমান ভ্রমণের বাজারে ভারতীয়দের অবদানের চতুর্থ। তবে ভবিষ্যতে পরিসংখ্যানের পরিবর্তন হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন: কানাডা-ভারত দ্বন্দ্ব, মাল্টিবিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের কী হবে?

সামরিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ব্রহ্ম চেলানি বলছেন, ট্রুডোর বক্তব্যে ভারত ও কানাডার মধ্যে দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কের যে ক্ষতি হয়েছে, তা মেরামত করতে সময় লাগবে। সম্ভবত কানাডায় সরকার পরিবর্তনের পরেই তা সম্ভব হবে।

আগামী বছরের অক্টোবরে কানাডায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সূত্র: বিবিসি

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।