ভারতের চাল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় সিঙ্গাপুরকে ছাড়, বাংলাদেশ কি পাবে?
সেদ্ধ চাল রপ্তানিতে গত মাসে হঠাৎ করে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ভারত, তা থেকে সিঙ্গাপুরকে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি। এরপর থেকে জল্পনা শুরু হয়েছে, একই সুবিধা কি বাংলাদেশও পেতে পারে?
এরই মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জয়পুরে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে গত সপ্তাহের বৈঠকে এই ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করেছেন বলে জানা গেছে। ভারতের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ তাদের কাছে বিরাট একটি বাজার এবং এই নিষেধাজ্ঞা থেকে বাংলাদেশ বা নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড় পেলে তারা অত্যন্ত খুশি হবেন।
ভারতীয় পর্যবেক্ষকরাও মনে করছেন, ঢাকার সঙ্গে দিল্লির ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক বিবেচনায় এ ধরনের সুবিধা দেওয়া উচিত– বিশেষ করে বাংলাদেশে যেহেতু আর মাস চারেক পরেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ। তারা বিশ্বের যেসব দেশে চাল রপ্তানি করে তার শীর্ষ পাঁচটির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান বলছে, ভারত থেকে অ-বাসমতি চাল আমদানির ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশ বেনিন ও সেনেগাল এবং দক্ষিণ এশিয়ার নেপালের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
গত ২০ জুলাই হঠাৎ করেই বাসমতি নয় এমন সব ধরনের সাদা চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারত। এর ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য বাজারে রীতিমতো অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ভারতকে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘও।
ভারত অবশ্য বলছে, দেশের বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাধ্য হয়েই তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
তবে বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশে চলতি মৌসুমে ফলন তেমন ভালো না হওয়ায় সেদ্ধ চাল আমদানির চাহিদা রয়েছে। এ অবস্থায় সিঙ্গাপুরের মতো বাংলাদেশকেও একই ধরনের ছাড় দেওয়া যায় কি না, দিল্লির সেই সিদ্ধান্তের দিকে পর্যবেক্ষকরা স্বাভাবিকভাবেই নজর রাখছেন।
সিঙ্গাপুরকে যেভাবে ছাড়
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে এক বিবৃতিতে জানায়, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ভারতের ‘অত্যন্ত নিবিড় কৌশলগত সম্পর্ক’ বিবেচনায় দ্বীপরাষ্ট্রটিকে চাল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
মাস দেড়েক আগে ভারত এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকেই সিঙ্গাপুর সরকার তা থেকে ছাড় পাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দিল্লির সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ রেখে চলছিল। সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যে অবশেষে ফল মিলেছে, ভারত সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপেই তা স্পষ্ট।
কেন এই সিদ্ধান্ত তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া দুই দেশের মানুষে-মানুষে সংযোগ বা পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্টও খুব শক্তিশালী।
পৃথিবীর প্রায় ৪০টির মতো দেশ ভারত থেকে চাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। সিঙ্গাপুরও তার একটি। ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ তিন হাজার কোটি ডলারের বেশি।
এছাড়া, সিঙ্গাপুরে জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও প্রধানত তামিল। তাদের খাদ্যাভ্যাসে সেদ্ধ চালের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
এসব বিষয় বিবেচনা করেই ভারত সিঙ্গাপুরকে এই বিশেষ ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিঙ্গাপুরের একটি সুপারমার্কেটে চালের প্যাকেটের স্তূপ। ছবি সংগৃহীত
২০২২ সালে ভারত যখন গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তখন আরব বিশ্বের বন্ধু রাষ্ট্র মিশরকে তা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেই কথা তখন প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়নি।
এখন সিঙ্গাপুরকে যেসব যুক্তিতে ভারত এই বিশেষ সুবিধা দিয়েছে, তার অনেকগুলোই বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সে কারণে অনেকে মনে করছেন, ঢাকাকেও একই সুবিধা দিলে দিল্লির কূটনৈতিক লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই!
জয়পুরে বাণিজ্যমন্ত্রীদের বৈঠক
জি-২০ জোটের বর্তমান সভাপতি ভারত গত সপ্তাহে জোটভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে। বিশেষ আমন্ত্রণে সেখানে উপস্থিত ছিল বাংলাদেশও।
ওই সম্মেলনের ফাঁকে গত ২৩ আগস্ট পীযূষ গয়াল ও টিপু মুন্সীর মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে বাংলাদেশ সরকারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভারত থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের রপ্তানি সহজ করতে একটি ‘প্রক্রিয়া’ প্রণয়ণের জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন টিপু মুন্সী।
ভারত সম্প্রতি পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর যে বাড়তি ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক বাসিয়েছে, সেটিও প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
জয়পুরে বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীরা। ছবি সংগৃহীত
বিবিসি জানিয়েছে, জয়পুরের বৈঠকে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী চাল রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটিও তুলেছিলেন। বাংলাদেশকে এর আওতার বাইরে রাখা যায় কি না সেটি বিবেচনা করতে পীযুষ গয়ালকে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের সেই অনুরোধে ভারত এখনো সায় দেয়নি। তবে সেটি খারিজও করে দেওয়া হয়নি।
এর আগে, চলতি মাসের মাঝামাঝি দিল্লিতে পীযূষ গয়ালের সঙ্গে বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের বৈঠকেও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছিল ভারত।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশে আমরা বছরে প্রায় এক কোটি টন সেদ্ধ চাল রপ্তানি করি। সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে পরিমাণটা তার ১০ শতাংশও নয়।
কাজেই সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে যত সহজে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া গেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ততটা সহজ না-ও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
ভারতে প্রতিক্রিয়া কেমন?
সব ধরনের অ-বাসমতি চাল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতের চাল রপ্তানিকারকরা যে ক্ষুব্ধ ও হতাশ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা চান যত দ্রুত সম্ভব এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক।
মুম্বাইয়ে চালের আড়তে বসা এক ব্যক্তি। ফাইল ছবি
দিল্লিতে রাইস ইন্ডিয়া এক্সপোর্টসের কর্ণধার তানিশক আগারওয়াল বলেন, এই নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল বলে আমরা মনে করছি!
তার কথায়, ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম এই মৌসুমে এতটা বাড়েনি যে দুম করে রপ্তানি বন্ধ করে দিতে হতো। এটি সরকারের ‘নি জার্ক রিঅ্যাকশন’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
পুনের চাল রপ্তানিকারক গঙ্গাধর কালবান্দেও বলেছেন, গত জুলাইয়ে সরকার নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকেই আমাদের কাছে ক্রেতাদের আসা হু হু করে কমতে শুরু করেছে।
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে রপ্তানিকারকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি ভারত সরকারের কোষাগারেও বৈদেশিক মুদ্রা অনেক কম আসছে।
ভারতের চাল রপ্তানিকারকরা তাই একবাক্যে বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা দরকার।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/