যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা
মাত্র দেড় বছর আগেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা। এর জের ধরে দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়। ফলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা সরকার। এমনকি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে।
বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে সেসময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে দেশটি আর আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিল না। এর জের ধরে খাদ্য, ওষুধসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়।
ওই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে দেশটি এবং জমে উঠতে শুরু করেছে। দেশটির অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পর্যটনখাত এবং দেশটির রেমিট্যান্সও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে শিগগিরই দেশটির অর্থনীতি আরও শক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
আরও পড়ুন: মানবপাচার মামলা: মালয়েশিয়ায় ৮ বছরে গ্রেফতার ৩১৯৩
কলম্বোর সাংবাদিক শিহার আনিজ বলছেন, দোকানে পণ্য নেই কিংবা মানুষের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো বিপর্যয়ের সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। বরং দাম বেশি থাকলেও নিত্য দরকারি সবকিছুর সরবরাহ এখন বাজারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
বিবিসিকে তিনি বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এ অর্থে যে কোথাও এখন আর লম্বা লাইন দেখা যায় না। দাম বেশি হলেও বাজারে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। জীবনযাত্রাও আগের তুলনায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
যদিও তিনি মনে করেন সংকট থেকে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি দেশটি। বরং বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা শুরু হলেই প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে বলছেন, সরকারি নীতি আর কিছু ‘অটোমেটিক’ বিষয়ের সমন্বয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা।
কী নীতির কারণে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা?
মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশটি যে ঘুরে দাঁড়াতে পারলো তার কারণ হিসেবে দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে।
আরও পড়ুন: ব্রিকসে নতুন ৬ সদস্য, নেই বাংলাদেশ
বিবিসিকে তিনি বলেন, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি পরিস্থিতির উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে রেমিট্যান্স ও পর্যটনের মতো কিছু ক্ষেত্রে অটোমেটিক রিকভারি হয়েছে। এ দুটির সমন্বয়েই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে আরও অনেক দূর যেতে হবে।
সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে এবং সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে। এর ফলও অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক দুনুসিংহে।
বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ এবং আইএমএফ-এর মতো সংস্থার সাথে সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স অনেকগুণ বেড়েছে। আবার পর্যটনের মতো খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি গত বছর বিপুল পরিমাণ দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেছে।
আগের বছরের তুলনায় এ বছর পর্যটন খাত থেকে শ্রীলঙ্কার আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। আর রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। অন্যদিকে সাংবাদিক ও বিশ্লেষক শিহার আনিজ বলছেন, সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো মুদ্রার অবমূল্যায়ণ আর ভর্তুকি কমিয়ে করজাল বিস্তৃত করে রাজস্ব আয় বাড়ানো।
শ্রীলঙ্কার সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর জুলাই মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ সময় কমেছে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি। অথচ বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের সংকটকালে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি।
তবে গত দশ মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমলেও এখনো বিপুল পরিমাণ দেশী বিদেশি ঋণের ভারে জর্জরিত দেশটি। মূলত কোভিড মহামারির ধাক্কায় দেশটির পর্যটন খাত ধসে পড়ায় এবং একই সাথে প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলে ২০২২ সালের শুরুতে ভয়ংকর সমস্যায় পড়ে দেশটি। সাথে যোগ হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে পণ্য আমদানির ব্যয় ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায় যা আর দেশটি সামাল দিতে পারেনি।
এ সংকটের জের ধরে নজিরবিহীন গণবিক্ষোভের মুখে ২০২২ সালের ১৩ জুলাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে।
এরপর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির দায়িত্ব নেন। অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে মনে করেন, শ্রীলঙ্কা আপাতত এ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে।
যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা
ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সাথে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের একটি ‘বেইল আউট প্যাকেজ’ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। চলতি বছরের মার্চে আইএমএফ বোর্ড সেটি অনুমোদন করে।
এরপর খাদ্যমূল্য, বিদ্যুতের দাম সামান্য কমানোর চেষ্টা করে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করে সরকার। এর অংশ হিসেবে ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। সাংবাদিক শিহার আনিজ এবং অধ্যাপক প্রিয়াঙ্গা দুনুসিংহে দুজনেই বলেন যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার শুরু থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেছে ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
আরও পড়ুন: ভারতের চন্দ্রজয়ের নেপথ্যে ৫৪ নারী বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী
আবার গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানো অতীতে সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে দেশটির তিন লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছে, যাদের অনেকেই ডাক্তার, প্যারামেডিকেল কিংবা আইটি প্রফেশনাল।
অবশ্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালেও জিডিপি হ্রাসের প্রবণতায় থাকবে শ্রীলঙ্কা। তবে ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে এটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এসে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হবে।সময়মত আমদানি বিষয়ক নীতি পরিবর্তন ছাড়াও অর্থনীতিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। বিশেষ করে আইএমএফ সমর্থিত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে শক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে।
তবে এই এক বছরে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে শ্রীলঙ্কার শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাত শতাংশ। কৃষিখাতও ভালো করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চা ও রাবার রপ্তানি বেড়েছে।
তবে এর মধ্যেও সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো কোনো খাতে কর বাড়ানো আবার কোনো খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো পদক্ষেপও নিতে হয়েছে রনিল বিক্রমাসিংহে সরকারকে। পাশাপাশি সংকট এড়াতে এগিয়ে এসেছিলো বিশ্বব্যাংকও।
চলমান প্রকল্পগুলো থেকে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ডলার তারা জরুরি প্রয়োজনের খাতে সরিয়ে নেয়। বিশেষ করে ওষধ, লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস এলপিজি, সার এর মতো পণ্যগুলো যেন মানুষ সহজে পেতে পারে সেজন্য এমন পদক্ষেপ নেয় সংস্থাটি। এছাড়া বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবেও শ্রীলঙ্কা সরকারকে ৭০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এখনো যেসব চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরে থেকে শ্রীলঙ্কার এখন মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কোনো কোনো সংস্থার হিসেবে এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি শোধ করতে হবে চীন, জাপান এবং ভারতকে। আবার মোট ঋণের মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে।
সরকার ঋণ পুনর্বিন্যাসের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করছে। আলোচনা সফল হলে ঋণ ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে দেশটির। শিহার আনিজ বলেন, কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বিদেশি ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম কিন্তু এখনো শুরু হয়নি।
সেটি যখন শুরু হবে তখন আসলে বোঝা যাবে আমাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলো। এর বাইরে পর্যটনকে আরও চাঙ্গা করা আর রেমিট্যান্স আরও বাড়িয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই দেশটির হাতে।
আরও পড়ুন: ক্যালিফোর্নিয়ার বারে গোলাগুলি, নিহত ৪
তবে দেশটিতে সংস্কার কার্যক্রমের বিরোধিতা করে ইতোমধ্যেই ট্রেড ইউনিয়নগুলো সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। খরচ কমাতে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্স, শ্রীলঙ্কা টেলিকম এবং শ্রীলঙ্কান ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশনের মতো রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থাগুলোকে বেসরকারিকরণের যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে, তার বিরোধিতা কাটিয়ে বাস্তবায়ন করাও হবে বিক্রমাসিংহে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এদিকে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাংলাদেশের কাছ থেকে এক বছর মেয়াদের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। চার কিস্তিতে নেওয়া সেই ঋণের ৫০ মিলিয়ন ডলার চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশকে ফেরত দিয়েছে দেশটি। এ মাসের শেষ নাগাদ আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে।
টিটিএন