পশ্চিম আফ্রিকায় একের পর এক অভ্যুত্থান, দায় কি পশ্চিমাদের?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫৯ পিএম, ০৭ আগস্ট ২০২৩
নাইজারে অভ্যুত্থান সমর্থকদের হাতে প্লাকার্ডে লেখা ‘বিদায় ফ্রান্স’। ছবি: সংগৃহীত

বুরকিনা ফাসো, গিনি, মালি, চাদের পর সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকার আরেকটি দেশ নাইজেরেও সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে। এর প্রতিটি দেশই ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ। লক্ষণীয় হলো, ১৯৯০ সাল থেকে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে মোট ২৭ বার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে, তার ৭৮ শতাংশই হয়েছে সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলোতে।

এ কারণে অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তোলেন, পশ্চিম আফ্রিকার এই অস্থিরতার পেছনে মূল দায় কি ফ্রান্সের? অথবা এই অঞ্চলটি কি এখনো ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের পরিণতি বহন করে চলেছে?

অভ্যুত্থানকারী নেতারা অবশ্য এমন সন্দেহকে বাহবাই দেবেন। মালির সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা কর্নেল আবুলায়ে মাইগা গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, ‘নব্য-ঔপনিবেশিক, আধিপত্যবাদী’ দেশটি ‘সার্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধ বর্জন করেছে’ এবং মালির ‘পিঠে ছুরি মেরেছে’।

আরও পড়ুন>> ক্ষমতা ছাড়বে না জান্তা, যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নাইজার

বুরকিনা ফাসোতেও ফ্রান্সবিরোধী মনোভাব এখন তুঙ্গে। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সামরিক সরকার ফরাসি সৈন্য মোতায়েন সম্পর্কিত দীর্ঘ দিনের চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়ে এক মাসের মধ্যে সব ফরাসি সৈন্যকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

মালি ও বুরকিনা ফাসোর প্রতিবেশী নাইজারের সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজউমকে উৎখাতের পর যুক্তি দেয়, তিনি ছিলেন ফ্রান্সের বসানো পুতুল, যার মূল লক্ষ্যই ছিল ফরাসি স্বার্থ রক্ষা করা।

শুধু তা-ই নয়, নাইজারের সেনাশাসক জেনারেল আব্দুরহমান চিয়ানি ফ্রান্সের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পাঁচটি সামরিক চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন। জান্তা সমর্থকরা নাইজারে ফরাসি দূতাবাসে হামলাও চালিয়েছে।

jagonews24নাইজারে অভ্যুত্থানের পক্ষের লোকজন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করছে। ছবি সংগৃহীত

তবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে এসব রোষের পেছনে ঐতিহাসিক কিছু কারণও রয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ফরাসিরা এসব দেশে এমন রাজনৈতিক পদ্ধতি চালু রেখেছিল, যার প্রধান লক্ষ্যই ছিল সম্পদ কুক্ষিগত করা। আর এই ব্যবস্থা বজায় রাখতে ফরাসিরা নির্যাতনমূলক বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছে।

আরও পড়ুন>> ক্ষমতায় থাকতে ওয়াগনারের সাহায্য চাইলো নাইজারের জান্তা

ব্রিটেনও তাদের উপনিবেশগুলোতে একই কাজ করেছে। তবে ফরাসিরা কাগজে-কলমে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার পরেও তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোতে শক্ত অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সেই চেষ্টা এতটাই জোরালো যে অনেক সমালোচক বলেন, ফ্রান্স এখনো তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সরাসরি নাক গলাচ্ছে।

পশ্চিম আফ্রিকার নয়টি ফরাসি ভাষাভাষী দেশের সাতটিতেই এখনো সিএফএ ফ্রাঁ মুদ্রা চালু রয়েছে। এসব মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয় ইউরোর মূল্যমানের ভিত্তিতে। আফ্রিকান এসব মুদ্রার বিনিময় মূল্যের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয় ফ্রান্স।

সাবেক এসব উপনিবেশগুলোর অধিকাংশের সঙ্গেই ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে, যার আওতায় প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন দেশে ফ্রান্সপন্থি অজনপ্রিয় রাজনীতিকদের ক্ষমতায় রাখতে ফরাসি সৈন্য মোতায়েন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন>> নাইজারে হামলার পরিকল্পনা করছে ফ্রান্স, দাবি জান্তার

এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে ফ্রান্সের মদতে অনেক দুর্নীতিপরায়ণ ও অত্যাচারী শাসক গণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। যেমন- চাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবি বা বুরকিনা ফাসোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ব্লেইজ কমপাওরে।

সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকায় যেসব সরকারপ্রধান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, তাদের সবাই ফ্রান্সপন্থি হিসেবে পরিচিত। যদিও তাদের রক্ষায় ফ্রান্স সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি।

এর চেয়ে খারাপ বিষয়টি হলো– ফ্রান্সের রাজনৈতিক নেতা ও আফ্রিকান মিত্রদের ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে প্রায়ই দুর্নীতি কেলেঙ্কারি জড়িত। এই সম্পর্কের ওপর ভর করে আফ্রিকায় একটি অভিজাত শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা জনগণের স্বার্থ-অধিকারের তোয়াক্কা করে না।

আরও পড়ুন>> মালিতে সেনা অভ্যুত্থান, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী গ্রেফতার

নব্য ঔপনিবেশিক এই সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ ফ্রাঁসোয়া-জাভিয়ের ভারসাভে ‘ফ্রসাফ্রিক’ নামে একটি শব্দ উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সম্পর্কের অন্তরালে রয়েছে ‘ফরাসী রাজনীতি ও অর্থনীতির উঁচু স্তরের কিছু মানুষের গোপন অপরাধ প্রবণতা’। ভারসাভে মনে করেন, এই সম্পর্কের কারণে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো থেকে প্রচুর টাকা-পয়সা, সম্পদ চুরি ও পাচার হচ্ছে।

ফ্রান্সের মিত্র রাজনীতিকরা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন এসব কেলেঙ্কারি প্রায়ই ঢাকা পড়ে থাকে। বিনিময়ে, ফ্রান্সের সামরিক সহযোগিতায় সেসব শাসকরা স্থিতিশীলতা রাখার সুযোগ পান।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্স ও পশ্চিমাদের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার সক্ষমতা কমেছে। পাশাপাশি, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খোলাখুলি সমালোচনাও বাড়ছে।

jagonews24নাইজারে অভ্যুত্থান সমর্থকরা রাশিয়াকে সমর্থন করছে। ছবি সংগৃহীত

আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে কট্টরপন্থিদের বিদ্রোহ দমনে ফ্রান্সের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো প্রচুর অর্থ সাহায্য দিয়েছে, সেনা মোতায়েন করেছে। কিন্তু সরকারগুলো কোনোমতেই বিশাল এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না।

আরও পড়ুন>> জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ফিরে যেতে বললো মালির সামরিক সরকার

ফলে, মালি এবং বুরকিনা ফাসোতে সরকারগুলো চাপে পড়েছে। এই দেশ দুটোতে এমন মনোভাব বাড়ছে যে, ফরাসিদের সাহায্যে তাদের ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি হচ্ছে। আর জনমনে এই ক্ষোভের কারণে সামরিক নেতারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সাহস পাচ্ছেন। তারা ভাবছেন, জনগণ তাদের সমর্থন করবে।

ফ্রান্সই যে একমাত্র ঔপনিবেশিক শক্তি যারা সাবেক উপনিবেশগুলোতে স্বৈরাচারী নেতাদের মদত দিয়েছে, তা কিন্তু নয়।

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র আনুগত্যের বিনিময়ে কেনিয়ার ড্যানিয়েল আরপ মই এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মবুতু সেসো সেকোর মতো অনেক স্বৈরাচারী শাসককে মদত দিয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে আফ্রিকার যে চারটি দেশে সবচেয়ে বেশি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে– নাইজেরিয়া (৮), ঘানা (১০), সিয়েরা লিওন (১০) এবং সুদান (১৭) – সবগুলোই ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ।

আরও পড়ুন>> তাইওয়ান নিয়ে তালগোল পাকিয়েছেন ম্যাক্রোঁ

তবে সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে সেনা অভ্যুত্থান হচ্ছে, তার পেছনে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে অভূতপূর্ব নিরাপত্তাহীনতার যোগ রয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহিংস তৎপরতা এবং অপরাধী চক্রের তৎপরতার কারণে বেসামরিক সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বেড়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।