ভোট কারচুপি, বিরোধীদের দমন, দুর্নীতি
যেভাবে ক্ষমতায় এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী
কয়েক বছর আগেই রাজনৈতিক বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করতে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে নির্দয় অভিযান চালিয়েছিলেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। সেসময় বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছিল এবং তার ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ছিল। এ অবস্থায় আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমনের কৌশল নেন হুন সেন।
বিরোধী দলের নেতাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করা হয়। গ্রেফতার করা হয় অনেককে। প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার ছয় মাস পরেই নির্বাচন দেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ২০১৮ সালের ওই নির্বাচনে দেশটির সংসদের ১২৫টি আসনের সবকটিতেই জয় পায় তার দল।
পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কম্বোডিয়ায়। আগামী রোববার (২৩ জুলাই) হতে যাওয়া এই নির্বাচনেও ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
আরও পড়ুন>> সরকারের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বরখাস্ত হলেন মন্ত্রী
‘এই নির্বাচন অর্থহীন, কারণ কোনো শক্তিশালী বিরোধী দলই এই নির্বাচনে নেই’, বলেন রাজধানী নম পেনের একজন ত্রাণকর্মী ও ভোটার।
তার কথায়, এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া এমন কোনো দল নেই, যে সংসদে গিয়ে জনগণের কথা বলবে। তাই মানুষের মধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই।
বর্তমানে ৭০ বছর বয়সী হুন সেন ১৯৮৫ সাল থেকে কম্বোডিয়া শাসন করছেন। ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা এ নেতা নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাবি করেন।
মূলত এই দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করেই কম্বোডিয়ার ক্ষমতা ধরে রেখেছেন হুন সেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের কারাগারে পাঠিয়ে, নির্বাসিত করে বা তাদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতার শীর্ষে নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখেছেন তিনি।
আরও পড়ুন>> ভোটে হেরে রাজনীতি ছাড়ছেন থাই প্রধানমন্ত্রী
কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে কম্বোডিয়া একটি একতান্ত্রিক, একদলীয় দেশে পরিণত হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী হুন সেন কোনো স্বৈরশাসকের চেয়ে কম নন।
এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি কম্বোডিয়া। জ্বালানির উচ্চমূল্য আর স্থির মজুরি সেখানকার মানুষের মূল সমস্যা। দুর্নীতি প্রায় মহামারি আকারে ছড়িয়েছে, জনগণের কাছে প্রশাসনের জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। তার ওপর জমি দখল আর অপরাধের মাত্রা বাড়তে থাকায় মানুষের জীবন আরও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
তবে জীবন নিয়ে এত অনিশ্চয়তা থাকলেও কম্বোডিয়ার প্রায় সবাই জানে যে, রোববারের ভোটে কম্বোডিয়ান পলিটিকাল পার্টি (সিপিপি) আবারও জিতবে।
লোক দেখানো নির্বাচন
এ বছর নির্বাচনের আগে কয়েক মাস ধরে হুন সেন তার একমাত্র কঠিন প্রতিপক্ষ ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে বিভিন্নভাবে দমন করেছেন। নির্বাচনের আগে শেষ মুহূর্তে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
সাবেক বিরোধীদলের ধ্বংসাবশেষ থেকে গত বছরই ক্যান্ডেললাইট পার্টির সূচনা হয়। গত স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ভোট জালিয়াতির প্রমাণ থাকা স্বত্ত্বেও ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল দলটি।
আরও পড়ুন>> ‘মোদী বনাম ইন্ডিয়া’: ভারতে ২৬ দলের নতুন জোট বিরোধীদের
এই বিষয়টি হুন সেন মেনে নিতে পারেননি। তাই তারা বড় হুমকি হয়ে ওঠার আগেই ‘ক্যান্ডেললাইটের শ্বাসরোধ’ করেন বলে মন্তব্য করেছেন অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরশাসক বিশেষজ্ঞ লি মরগেনবেসার।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যান্ডেললাইট পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ শুরু করেন হুন সেন। পরে মে মাসে দলটিকে নিষিদ্ধ করেন। কম্বোডিয়ার নির্বাচনী অফিস আইনি মারপ্যাচে ফেলে ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ ঘোষণা করে।
এ বছরের নির্বাচনে আরও ১৭টি দল অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু তারা হয় অনেক ছোট অথবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে কারণে এই দলগুলোকে নির্বাচনে একেবারেই তাৎপর্যহীন মনে করা হচ্ছে।
ক্যান্ডেললাইট পার্টির এক প্রতিনিধি বলেন, আমরা নির্বাচনের জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এমন একটি প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে আমাদের নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, যেটি কয়েকদিন আগেও ছিল না। খেলার মাঝখানে তিনি (হুন সেন) নিয়ম বদলে দিয়ে এই কাজ করলেন।
আরও পড়ুন>> বিরোধীদের ২৬ দলের বিপরীতে মোদীর ৩৮ দলীয় জোট
ক্যান্ডেললাইট পার্টির অনেক নেতাই এখন গ্রেফতারির ভয়ে রয়েছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অনেক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডে জাতিসংঘের শরণার্থী কার্যালয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাংকক থেকে গ্রেফতার করা হয় দুই নেতাকে।
গণতন্ত্রের অধঃপতন
নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা থাকলেও কম্বোডিয়ার নির্বাচনে সবসময়ই সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। তবু ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগপর্যন্ত সেগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো।
কিন্তু ২০১৭ সালে বিরোধী জোট শক্তিশালী হতে থাকায় হুন সেন ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় কঠোর হতে শুরু করেন। সে সময় দেশটির দুই অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ স্যাম রেইনসি এবং কেম সোখার নেতৃত্বাধীন জোট কম্বোডিয়ান ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি (সিএনআরপি) স্থানীয় নির্বাচনে বিপুল ভোট পায়।
এই জোটই ২০১৩ সালের নির্বাচনে ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ওই নির্বাচনের সময় ভোট গণনার রাতে একপর্যায়ে যখন সিএনআরপি ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছিল, তখন সরকার টেলিভিশনে ভোট গণনা সম্প্রচার করা বন্ধ করে দেয়।
আরও পড়ুন>> রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিলেন নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী
সেবারের নির্বাচনে হুন সেনের জয়ের বিরোধিতা করে পরের কয়েক মাস বিক্ষোভ করে বিরোধী দলগুলো। বিভিন্ন শহরের পথে পথে রাজনৈতিক র্যালিগুলোতে অংশ নিতো হাজার হাজার মানুষ।
সেসময় নমপেনে থাকা রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাস্ট্রিড নরেন নিলসন বলেছিলেন, শহরের রাস্তায় উপস্থিত মানুষের, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তাপের বাঁধভাঙা প্রকাশ দেখা যাচ্ছিল।
সেবার বিরোধীদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে বিক্ষোভের অবসান ঘটান হুন সেন। সিএনআরপির নেতা রেইনসির সঙ্গে তিনি একটি চুক্তি করেন। তবে ২০১৩ সালে সমঝোতা করলেও ২০১৭ সালে সিএনআরপি যখন আরও শক্তিশালী হতে শুরু করে, তখন আর কোনো ঝুঁকি নেননি কম্বোডিয়ান প্রধানমন্ত্রী।
নিজ দলের নিয়ন্ত্রিত সংসদকে ব্যবহার করে তিনি আইনে পরিবর্তন আনেন যেন নিরাপত্তার খাতিরে যে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা যায়। তারপর এই নতুন ক্ষমতা ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টকে প্রভাবিত করেন সিএনআরপিকে নিষিদ্ধ করতে।
তারপর থেকে অন্তত ১০০ জন সিএনআরপি সদস্য মামলার শিকার হয়েছেন। দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
আরও পড়ুন>> থাইল্যান্ডে নির্বাচন: সেনা-সমর্থিত সরকারের মুখে তারুণ্যের চপেটাঘাত
মার্চ মাসে সিএনআরপির আরেক শীর্ষ নেতা কেম সোখাকে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দেন কম্বোডিয়ান আদালত। সেই রায়কে ‘সাজানো ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি হুন সেন অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপরও চড়াও হন। দ্য ক্যাম্বোডিয়া পত্রিকা বন্ধ করা, আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাগুলোকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার মতো পদক্ষেপ নেন তিনি।
তার এসব পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে কম্বোডিয়ার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেয় বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু চীনের সমর্থন পাওয়া হুন সেন সেসবে বিচলিত হননি।
ফেব্রুয়ারিতে ভয়েস অব ডেমোক্র্যাসি অফিসে পুলিশের অভিযান। ছবি সংগৃহীত
কিছুদিন আগে দেশটির সবশেষ মুক্ত সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব ডেমোক্র্যাসি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এনজিওগুলোর নিবন্ধন বাতিল করারও হুমকি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্লেষকদের মতে, হুন সেনের কৌশল খুবই সাধারণ এবং সবার জানা।
আরও পড়ুন>> নির্বাচন নিয়ে কথা বলা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়: যুক্তরাষ্ট্র
সহকারী অধ্যাপক মরগেনবেসার বলেন, তিনি ঘুস, অর্থ, ভালো সরকারি চাকরি ও জায়গা-জমি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বিরোধীদের হাত করার চেষ্টা করেন। যখন তাদের দলে টানতে পারেন না, তখন তাদের ধ্বংস করতে পদক্ষেপ নেন।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হুন সেনের সরকার বিরোধীদের ওপর হয়রানি বাড়িয়েছে ও বিরোধী দলের সদস্যদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করছে।
বিভিন্ন গ্রামে ক্ষমতাসীন দলের এজেন্টরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট কিনছে এবং যাদের ভোট কেনা যাচ্ছে না তাদের হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/