শ্রীলঙ্কায় এখন কাঁঠাল খেয়েই বেঁচে আছে লাখ লাখ মানুষ
এক বছর আগে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিক্ষুব্ধ জনতার রোষের মুখে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশটি এখন দারিদ্র্যে ধুঁকছে। খাবার জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির বড় একটি জনগোষ্ঠী। তিন সন্তানের পিতা দিনমজুর কারুপ্পাইয়া কুমার বলেন, কাঁঠাল খেয়ে আমরা লাখ লাখ মানুষ প্রাণে বেঁচে আছি। অনাহারের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে এই কাঁঠাল।
একসময় ফল হিসেবে সবচেয়ে অবজ্ঞা করা হতো যে কাঁঠালকে সেটাই এখন মানুষের প্রাণ রক্ষাকারী খাবারে পরিণত হয়েছে। সেখানে প্রায় এক ডলার সমমূল্যে ১৫ কেজি ওজনের একটি কাঁঠাল পাওয়া যায়। ৪০ বছর বয়সী এই দিনমজুর বলেন, অর্থনৈতিক সঙ্কটের আগে প্রতিটি মানুষের ভাত বা পাউরুটি কেনার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এখন খাবারের দাম এতটাই নাগালের বাইরে চলে গেছে যে বহু মানুষ প্রায় প্রতিদিন কাঁঠাল খেয়ে বেঁচে আছে।
শ্রীলঙ্কার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে রয়েছে। এখন প্রতি দুটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারকে বাধ্য হয়ে তাদের আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি খাবার-দাবারের জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে।
নাদিকা পেরেরা নামে তিন সন্তানের এক জননী বলেন, আগে আমরা তিন বেলা খেতাম। এখন খাচ্ছি দুবেলা। ১২ কেজি ওজনের রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম গত বছর পর্যন্ত ছিল ৫ ডলার। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, সিলিন্ডারের দাম এখন দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। ফলে এখন বাধ্য হয়ে পুরোনো পদ্ধতিতে চুলা জ্বালিয়ে রাঁধতে হচ্ছে। নারকেলের খোলা দিয়ে চুলায় আগুন জ্বালাচ্ছিলেন তিনি। ফলে চোখ জ্বালা করা বিষাক্ত ধোঁয়া তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
শ্রীলঙ্কা তার ইতিহাসে সবচেয়ে নজিরবিহীন গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে ২০২২ সালে। দেশটির অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় এরপর থেকে মানুষের আয় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। সঙ্কটে বিপর্যস্ত দেশটিতে বিরামহীন বিদ্যুতের অভাব আর জ্বালানির মজুত ফুরিয়ে আসায় তীব্র জনরোষ সৃষ্টি হয়। এর তার জেরে গত বছরের ৯ জুলাই জনগণ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের সরকারি বাসভবনে চড়াও হয়। তীব্র ক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন রাজাপাকসে।
এরপর দেশটির সরকার দেনদরবার করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ জোগাড় করতে সমর্থ হলেও দ্বীপরাষ্ট্রটিতে দারিদ্র্য দ্বিগুণ বেড়েছে। স্বামী ও সন্তান নিয়ে নাদিকা থাকেন রাজধানী কলম্বোর ছোট একটি ফ্ল্যাটে। সেখানে শোবার ঘর মাত্র দুটি।
নাদিকা জাতীয় ক্যারাম চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী সাবেক প্রতিযোগী। কিন্তু তিনি অর্থের অভাবে আছেন। ক্যারাম এশিয়ার জনপ্রিয় একটি খেলা। কিন্তু ক্যারাম খেলায় রেফারি হয়ে তিনি যে অর্থ উর্পাজন করতেন তা এখন বন্ধ। তার স্বামী এখন জীবিকার তাগিদে ভাড়ায় ট্যাক্সি চালান।
নাদিকা বলেন, মাংস বা ডিম কেনার সামর্থ্য এখন আর আমাদের নেই। এসবের দাম বেড়ে গেছে ছয়গুণ। বাসভাড়া এতটাই বেড়েছে যে আমরা প্রতিদিন বাচ্চাদের বাসভাড়া জোগাতে পারছি না। ফলে প্রায়ই তাদের স্কুল কামাই করতে হচ্ছে। আমি প্রার্থনা করি যেন একদিন রান্নার গ্যাস আর বিদ্যুতের বিল কমে আমাদের নাগালের মধ্যে আসে।
দেশটির মুদ্রাস্ফীতি গত জুন মাসে ১২ শতাংশে নেমে আসে। ফেব্রুয়ারিতে তা ছিল ৫৪ শতাংশ। তারপরেও পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। কারুপ্পাইয়া কুমারের স্ত্রী রাবার চাষের কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু বর্ষার মৌসুমে তিনি কাজ করতে পারেন না। রাবার গাছের কাণ্ডে খাঁজ কাটার কাজ করেন তিনি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা রাবার সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বর্ষার মৌসুম সে কাজ এখন বন্ধ। ফলে এ সময়টায় কারুপ্পাইয়া কুমারের একাই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়।
কারুপ্পাইয়া কুমার জীবিকার তাগিদে নারিকেল গাছে উঠে নারিকেল পাড়েন। প্রতিবার ওঠায় তার আয় হয় ২০০ শ্রীলঙ্কান রুপি (৬৫ সেন্টের সম পরিমাণ)। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও টানতে হয়। কাজেই খাবার কেনার জন্য খুব কম পয়সা হাতে থাকে।
তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেও ঘরে বসে থাকার উপায় আমার নেই। বৃষ্টির মধ্যেই আমাকে নারিকেল গাছে উঠে নারিকেল পাড়তে হয়। পরিবারের ভরণপোষণ তো করতে হবে। এই কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে পুরো ওয়াাকিবহাল তিনি। কিন্তু কিছু করারও নেই।
দক্ষিণাঞ্চলে পাশেই বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি এলাকা পালেন্দা। সেখানে বাস করেন প্রায় দেড়শ পরিবার। তাদের প্রায় সবাই কৃষক ও শ্রমজীবী।
দেশটিতে এখন প্রায় অর্ধেক শিশুর ওজন বয়সের তুলনায় কম এবং তারা অপুষ্টির শিকার। এক বছরের ওপর অর্থনৈতিক কঠিন অবস্থা চলার কারণে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। দেশটির দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কথা।
শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৮৫ শতাংশ ওষুধ বাইরে থেকে আমদানি করা হয়। কাজেই অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হওয়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ে ঘাটতির কারণে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্রের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে।
শৈলশহর ক্যান্ডির শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোয়া ডি জয়সা এই পরিস্থিতির শিকার। তার ফুসফুসের ফাইব্রোসিসের চিকিৎসার জন্য ভারত থেকে ওষুধ আনতে তাকে রীতিমতো বেগ পেতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত নয় মাস আগে তিনি মারা যান।
তার স্ত্রী মালিনী ডি জয়সা বলেন, ওষুধ আনাতে অনবরত যে ধরনের বিলম্বের শিকার তাকে হতে হচ্ছিল তা নিয়ে রীতিমতো হতাশ ছিলেন তিনি। কিন্তু তার বই লেখার কাজ তিনি থামাননি। তিনি জানতেন, তার মৃত্যু আসন্ন কারণ ওষুধ ছাড়া এই রোগ থেকে সেরে ওঠা সহজ নয়। মালিনী দুঃখ করে বলেন, অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে তার শেষের মাসগুলো আমাদের জন্য কিছুটা চাপমুক্ত হতে পারতো। আমরা বিশাল দেনা শোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।
কলম্বোর একটি মাত্র বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতালের ভেতরেও দুঃসহ পরিস্থিতির চিত্র পরিষ্কার। হাসপাতালের ভেতরের ক্লিনিকের বাইরে বসেছিলেন ৪৮ বছর বয়সী স্তন ক্যানসারের রোগী রামানি অশোকা। তার দ্বিতীয় দফার কেমোথেরাপি শুরু হওয়ার কথা আগামী সপ্তাহে। তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন তার স্বামী।
রামানি অশোকা বলেন, এই হাসপাতালে আসতে এমনিতেই প্রচুর খরচ হয়, যদিও এখন পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যেই ওষুধ দেওয়া হচ্ছিল। এখন কোনো একটা ফার্মেসি থেকে আমাদের ওষুধ কিনতে হবে। কারণ কোন ওষুধের দোকানের স্টকে ওষুধ নেই।
শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেহেলিয়া রাম্বুওয়েলা ইতোমধ্যেই মানুষজনকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে চড়া দাম এবং ঘাটতি থেকে অবিলম্বেই পুরো পরিত্রাণের কোনো সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, ভেবে দেখুন আমাদের যে স্বল্প পরিমাণ সঞ্চিত মুদ্রা আছে তা দিয়ে আমরা কী আমদানি করবো সেই কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হচ্ছে- খাদ্যদ্রব্য নাকি ওষুধ? অনাহারে থাকার সঙ্কট এড়াতে আমাদের তো খাবার আমদানি করতে হবে। তবে পায়ের তলায় এখন কিছুটা মাটি তৈরি হয়েছে এবং পরিস্থিতির ক্রমান্বয়ে উন্নতি হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
তবে সাধারণ মানুষকে তাদের বেঁচে থাকার পথ এখন নিজেদেরই খুঁজে নিতে হচ্ছে। আগে কাঁঠাল এখানে সেখানে পড়ে থাকত। মাঠে পড়েই পচতো। কিন্তু সেটাই এখন অনেক পরিবারের প্রধান খাবার হয়ে উঠেছেন বলে জানান কারুপ্পাইয়া। তিনি বলেন, এক পাত্র সেদ্ধ করা কাঁঠাল আমাদের পরিবারের পাঁচজন সদস্যের সারাদিন খাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে তিনি একটি অভিনব চুক্তি করেছেন কারণ তার জমিতে কোনো কাঁঠাল গাছ নেই। তিনি বলেন, আমি প্রতিবেশীদের কাঁঠাল গাছে উঠে তাদের জন্য কাঁঠাল পেড়ে দেই। এজন্য আমি কোনো পয়সা নেই না তারা দিতে চাইলেও নেই না। আমি বরং বিনিময়ে তাদের গাছ থেকে একটা করে কাঁঠাল বাসায় নিয়ে যাই। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তার আস্থা নেই কিন্তু আস্থা আছে প্রকৃতির ওপর। তিনি বলেন কাঁঠাল আর নারকেল গাছগুলোই আমার কাছে এখন বাবা-মায়ের মতো।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিটিএন