জ্বালানি হিসেবে শূকরের চর্বির ব্যবহার, সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞরা
মৃত শূকর, গবাদিপশু এবং মুরগির চর্বি গ্রিন জেট ফুয়েল তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তারা বলছেন, এভাবে গবাদিপশুর চর্বি জেট ফুয়েলে ব্যবহার পৃথিবীর জন্য আরও খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে। পশুর চর্বিকে বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া এ ধরনের উপাদান থেকে তৈরি বিমানের জ্বালানিতে অনেক কম কার্বন নিঃসরণ হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে গবাদিপশু থেকে তৈরি জ্বালানির চাহিদা তিনগুণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, পর্যাপ্ত পরিমাণ পশুর চর্বির অভাবে অন্যান্য শিল্পকে আরও বেশি পাম তেল ব্যবহার করতে বাধ্য করবে। কিন্তু পাম তেল থেকে পরিবেশে বেশি পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়। এয়ারলাইন্সগুলো বেশি পরিমাণ কার্বন নির্গমনের লাগাম টানতে ইতোমধ্যে চাপের মধ্যে রয়েছে। মূলত বিমানের ইঞ্জিনে জীবাশ্মভিত্তিক কেরোসিন পোড়ানোর ফলে বেশি কার্বন নিঃসরণ হয়। সে কারণে বিভিন্ন বিমান সংস্থা জ্বালানির ক্ষেত্রে পশুর চর্বির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এতে অন্য শিল্পগুলোও চাপে পড়ছে। তারা পশুর চর্বির বিকল্প খুঁজতে গিয়ে পাম তেলের ব্যবহারের দিকে বেশি ঝুঁকতে শুরু করেছে। পরোক্ষভাবে এটাও পরিবেশের ক্ষতির আরেকটি কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অপরদিকে ব্রাসেলসভিত্তিক ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের একটি ক্যাম্পেইন গ্রুপের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতি বছর এয়ারলাইন্সগুলোতে যে পরিমাণ পশুর চর্বির চাহিদা তৈরি হচ্ছে সে পরিমাণ পশু জবাই করা হয় না বা সে পরিমাণ উৎস নেই। ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের কর্মকর্তা ম্যাট ফিঞ্চ বলেন, এই চাহিদা দিন দিন কমবে না বরং বাড়বেই।
তিনি বলেন, আপনি যদি বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে যে কোনো জায়গা থেকে অতিরিক্ত চাহিদার উত্স তৈরি করেন সেক্ষেত্রে বর্তমানে যে শিল্পগুলো চর্বির ব্যবহার করছে তাদের বিকল্প অনুসন্ধান করতে হবে। আর সেই বিকল্পটি হচ্ছে পাম তেল। তাই ইউরোপীয় পদ্ধতিতে পাম তেলের ব্যবহার বাড়ানোর কারণে পরোক্ষভাবে বিমান চলাচলই এক্ষেত্রে দায়ী হবে।
পাম তেলের অতিরিক্ত ব্যবহার ক্রমবর্ধমান কার্বন নির্গমনের সঙ্গে যুক্ত। কারণ পাম ফলের পুরোনো বাগানে নতুন আবাদের জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এ থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হয়। তবে প্রাণিজ চর্বিও যে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেটা অনেকের কাছেই হয়তো অবাক হওয়ার মতো বিষয়।
যদিও কয়েক শতাব্দী ধরে মোমবাতি, সাবান এবং প্রসাধনী তৈরিতে প্রাণীর চর্বি ব্যবহার হয়ে আসছে। গত ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্য এবং বিভিন্ন দেশে প্রাণীর বর্জ্য বা ব্যবহৃত রান্নার তেল থেকে তৈরি বায়োডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে।
নতুন গবেষণা অনুসারে, ২০০৬ সাল থেকে ইউরোপজুড়ে মৃত প্রাণী থেকে তৈরি জ্বালানি ৪০ গুণ বেড়েছে। এই উপাদানগুলোর বেশিরভাগই গাড়ি এবং ট্রাকে বায়োডিজেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি টেকসই জ্বালানি হিসেবে পরিচিত এবং এতে কার্বন নিঃসরণ অনেক কম হয়। তবে বিমান চলাচলকে আরও বিশুদ্ধ রাখতে এ ধরনের বর্জ্যের ব্যবহার বাড়াতে খুবই আগ্রহী যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউয়িনভুক্ত বিভিন্ন দেশের সরকার।
এক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জিং প্রস্তাব রেখেছে। এর আওতায় এয়ারলাইন্সগুলোকে টেকসই বিমান জ্বালানির (এসএএফ) একটি বড় অনুপাত ব্যবহার করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের জন্য এটি ১০ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জন্য ৬ শতাংশ হবে। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের মতে, এ পরিকল্পনাগুলো পশু বর্জ্যের বর্তমান বাজারে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়া যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাজ্য সম্ভবত জ্বালানিতে উন্নত মানের চর্বি জাতীয় পদার্থ ব্যবহার সীমিত করতে পারে। অপরদিকে ইউরোপে এ ধরণের উপাদানের ব্যবহারে উত্সাহিত করা হবে। কারণ এই চর্বি দিয়ে গ্রীনহাউস গ্যাস হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এ ধরনের জিনিসের দাম বাড়বে। ফলে যুক্তরাজ্য থেকে সম্ভবত রপ্তানিতে উত্সাহ বাড়বে।
একটি বিমানে জ্বালানির জন্য আসলে কতগুলো মৃত শূকর প্রয়োজন? এর জবাব পাওয়া যাবে ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের কাছ থেকে। তাদের মতে, আপনি যদি পুরো জ্বালানির জন্য প্রাণীর উৎসের ওপর নির্ভরশীল হতে চান তবে প্যারিস থেকে নিউইয়র্কের একটি ফ্লাইটে ৮ হাজার ৮০০টি মৃত শূকরের চর্বি প্রয়োজন।
যুক্তরাজ্যের প্রাণীজ পণ্য এবং ব্যবহৃত রান্নার তেলের ব্যবহার সীমিত করার সম্ভাবনা থাকায় ব্রিটেনজুড়ে যেসব ফ্লাইটে জ্বালানি সরবরাহ করা হবে তাদের ইঞ্জিনে পশু-উত্পাদিত উপাদানের সামান্য পরিমাণ থাকতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্সগুলোতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই বিমান জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা থাকবে ৬ শতাংশ। এর মধ্যে ১ দশমিক ২ শতাংশই কেরোসিন থেকে আসতে হবে। বাকি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ সম্পূর্ণরূপে পশু চর্বি থেকে আসবে। এক্ষেত্রে প্রতি ট্রান্সআটলান্টিক ফ্লাইটে প্রায় ৪০০ শূকরের চর্বির প্রয়োজন হবে।
তবে বিমানের জ্বালানি ছাড়া আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশুর চর্বির ব্যবহার হয়। এমনকি প্রাণী খাদ্যের ক্ষেত্রেও এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ৩ কোটি ৮০ লাখ পোষা প্রাণীর খাবারের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উন্নত মানের এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়।
ইউকে পেট ফুডের উপ-প্রধান নির্বাহী নিকোল প্যালি বলেন, এগুলো আমাদের জন্য সত্যিই খুব মূল্যবান উপাদান এবং এগুলোর বিকল্প খুঁজে বের করাও কঠিন।
তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে এই উপাদানগুলো জৈব জ্বালানিতে বেশি ব্যবহারের কারণে অন্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এটি আমাদের বিমান শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ফেলে দিচ্ছে। যখন এভিয়েশন সেক্টরের কথা আসে, তখন পোষা প্রাণীর খাদ্য শিল্পে প্রতিযোগিতা করা সত্যিই কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে।
ইইউ যখন এ ধরনের উপাদান ব্যবহার বাড়াচ্ছে, যুক্তরাজ্য তখন জেট ফুয়েলে প্রাণীর চর্বি সীমিত করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে। সরকার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে বিমান চলাচল খাতে পশুর চর্বি এবং ব্যবহৃত রান্নার তেল উভয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা কঠোর সীমাবদ্ধতার কথা ভাবছে।
সূত্র: বিবিসি
টিটিএন/এএসএম