পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এরদোয়ান কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে অভিনন্দন জানাতে বিশ্বনেতাদের মধ্যে যে তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করা গেছে, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে শক্ত ধারণা পাওয়া যায়। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তুরস্কের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।
৬৯ বছর বয়সী এরদোয়ান দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। গত রোববার দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী কামাল কিলিকদারোগ্লুকে হারিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো তুর্কি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসতে চলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন>> তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের জয়
এরদোয়ান তার ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পারায় বেশ আগেভাগেই অভিনন্দন জানান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ বিষয়ে তিনি এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে, নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করা পর্যন্তও অপেক্ষা করেননি। সরকারিভাবে ফল ঘোষণার আগেই রুশ প্রেসিডেন্ট শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, এরদোয়ানের ‘নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ তার বিজয়ের অন্যতম কারণ।
রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
ইউক্রেনে পুরোদমে সামরিক অভিযান শুরু করার পর ন্যাটো জোটে তুরস্কের মিত্র দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং রুশ জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনে, তখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ক্রেমলিনকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান।
এরদোয়ান ও পুতিন।
এছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের ব্যাপারে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনাও হয়েছিল। জাতিসংঘের উদ্যোগে কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ চলাচলের বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া সমঝোতাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এরদোয়ানের।
আরও পড়ুন>> ইউক্রেনকে এস-৪০০ দেওয়ার মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান তুরস্কের
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন তুরস্ক-রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ উল্টো উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এসব কারণে এরদোয়ানকে পছন্দ করতেই পারেন ভ্লাদিমির পুতিন।
পিছিয়ে নেই পশ্চিমারা
তবে বিশ্বনেতাদের মধ্যে শুধু যে রুশ প্রেসিডেন্টই এরদোয়ানকে দ্রুত অভিনন্দন জানিয়েছেন, তা নয়। এই দৌড়ে পিছিয়ে ছিলেন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁও। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ন্যাটোর পক্ষ থেকেও এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুন>> যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে নতুন কৌশল তুরস্কের
জো বাইডেন এক টুইটে বলেছেন, বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা একসঙ্গে কাজ করা অব্যাহত রাখতে চাই।
ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ফ্রান্স ও তুরস্ককে একসঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপে শান্তি ফিরিয়ে আনা, ইউরো-আটলান্টিক জোটের ভবিষ্যৎ, ভূমধ্যসাগর। পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় আমি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানাই, আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখবো।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়েছেন এরদোয়ান।
বিবিসির ইউরোপ বিষয়ক সম্পাদক কাটিয়া এডলার বলছেন, পশ্চিমা নেতারা ক্রেমলিনের সঙ্গে এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠতা মোটেও পছন্দ করেন না। পছন্দ করেন না তার দুই দশকের শাসনামলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে খর্ব করার মতো বিষয়গুলোও। কিন্তু তারপরেও তুরস্ক তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তুরস্ক। ন্যাটোর সব অভিযানেই অংশ নিচ্ছে দেশটি।
এডলার বলেন, এরদোয়ান হয়তো রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে ইউক্রেনকেও তিনি সামরিক সাহায্য দিচ্ছেন।
ন্যাটোর সম্প্রসারণ
ন্যাটো সম্প্রসারণের ব্যাপারে তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই জোটের সংবিধানে বলা হয়েছে, নতুন কোনো দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে জোটের সব সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন। কোনো একটি সদস্য দেশ আপত্তি জানালে কাউকে জোটের সদস্য করা যাবে না।
সম্প্রতি ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার যে আবেদন জানিয়েছিল, সে বিষয়ে সবার দৃষ্টি ছিল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দিকে। অনেক দ্বিধা ও সংশয়ের পর শেষ পর্যন্ত তিনি রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ডের ন্যাটোয় যোগদানে অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু সুইডেনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে রয়েছে।
আরও পড়ুন>> ফিনল্যান্ডকে ছাড় দিলেও সুইডেনকে আটকাবে তুরস্ক: এরদোয়ান
সেই সুইডেনের প্রেসিডেন্টও এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টেনসন বলেছেন, দুই দেশের ‘নিরাপত্তাই’ তাদের ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকার।
ন্যাটো মহাসচিবের পাশে এরদোয়ান।
এরদোয়ান সরকারের অভিযোগ, সুইডেন কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি বা পিকেকের সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছে। তুরস্ক এই সংগঠনটিকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
আরও পড়ুন>> সুইডেনে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় মুসলিম বিশ্বে নিন্দার ঝড়
সুইডেনের ন্যাটোয় যোগদানের ব্যাপারে তুরস্কের অনুমোদনের জন্য হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে এরদোয়ানকে প্রভাবিত করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর বাকি সদস্যরা মনে করছে, সুইডেনকে এই সামরিক জোটের সদস্য করা হলে বাল্টিক সাগরে রাশিয়াকে মোকাবিলা সহজ হবে।
‘নিরপেক্ষ নীতি’
তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করতে একসময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রচুর চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তার সেই লক্ষ্য এখনো সফল হয়নি। তবে ইদানিং তিনি ইইউতে যোগদানের ওপর খুব বেশি জোর না দিয়ে বরং তুরস্ককেই ‘আবারও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলছেন।
এরদোয়ান তুরস্কের জন্যে একটি ‘নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ তৈরি করতে পেরেছেন এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। সহজ করে বললে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট মূলত মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে ‘লেনদেনের সম্পর্ক’ গড়ে তুলেছেন। আর এই সম্পর্কের পেছনে তিনি তুরস্কের স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
আরও পড়ুন>> কোরআন পোড়ানোর পর তুরস্কে কনস্যুলেট বন্ধের হিড়িক ইউরোপীয়দের
পশ্চিমা দেশগুলো আশা করছে, তুরস্কের বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে তারা হয়তো দেশটিকে চাপের মধ্যে রাখতে পারবে। কারণ আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল করার জন্য এরদোয়ানকে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে।
তুরস্ক ও হাঙ্গেরি ন্যাটোর একমাত্র সদস্য, যারা এখনো এই জোটে সুইডেনের সদস্য হওয়ায় বাধা দিচ্ছে। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবানও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ইউরোপের স্বার্থ
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউরোপীয় দেশগুলোতে শরণার্থী-অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি আশা করছেন, এই প্রবণতা ঠেকাতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট হয়তো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের আশ্বস্ত করতে পারবেন।
২০১৫ সালের অভিবাসন সংকটের সময় ১০ লাখের বেশি শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী নৌকায় চড়ে ভূমধ্যসাগরের বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এদের বেশিরভাগই ছিলেন সিরিয়ার নাগরিক।
আরও পড়ুন>> ভূমিকম্পের পর তুরস্কে সিরীয় শরণার্থীবিরোধী মনোভাব বাড়ছে
এর পরপরই অভিবাসীদের অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ ঠেকাতে ইইউ ও তুরস্কের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। চুক্তিতে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের তুর্কি জলসীমায় আটকে দেওয়ার বিনিময়ে তুরস্ককে বিরাট অংকের অর্থ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউরোপ।
একইসঙ্গে, তুর্কি নাগরিকদের ভিসা ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের ওপর দমনপীড়নের অভিযোগে ইইউ এই সুবিধা দিতে অসম্মতি জানিয়ে আসছে।
তবে তুরস্কের ভেতরে সিরীয় শরণার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় তুর্কিরা ক্রমশ অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছেন। এ কারণে নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই এই শরণার্থী ও অভিবাসন সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন>> অভিবাসনপ্রত্যাশীদের টাকা-পয়সা লুট করে ফেরত পাঠাচ্ছে গ্রিস
এ বিষয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা মনে করছে, শরণার্থীদের তুরস্ক থেকে জোর করে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো হলে তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
আবার ব্রাসেলস মনে করে, এমনটি হলে শরণার্থীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করবে।
গ্রিস ও সাইপ্রাস ইস্যু
এসবের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য গ্রিসের সঙ্গে তুরস্কের বিরোধ রয়েছে। এজিয়ান সাগরের বেশ কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে এই বিরোধ।
পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং এজিয়ান সাগর এলাকায় গ্রিসের বহু দ্বীপ রয়েছে যা তুরস্কের খুব কাছে এবং উপকুল থেকে দেখা যায়। ফলে সেখানে কার সমুদ্র-সীমা কোথায় তা নির্ধারণ এক জটিল ব্যাপার। অতীতে এ নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
একই সঙ্গে, ইইউর আরেক সদস্য দেশ সাইপ্রাসও এরদোয়ানের ওপর চাপ দিয়ে আসছে, যেন তুরস্ক সেখানকার সমস্যার ‘দুই দেশভিত্তিক সমাধানের’ পদক্ষেপ নেয়।
আরও পড়ুন>> শরণার্থী প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ালো গ্রিস
ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে বিভক্ত। ১৯৭৪ সাল থেকে দেশটি বিভক্ত অবস্থায় রয়েছে। সেসময় দেশটির গ্রিক অধ্যুষিত অংশে অভ্যুত্থান হলে তুরস্ক সাইপ্রাসের উত্তরাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়। তারপর থেকেই এ সমস্যা নিয়ে বিরোধ চলছে এবং এটি সমাধানে ‘দুই রাষ্ট্র (গ্রিক ও তুর্কি) সমাধানের’ কথা বলা হচ্ছে।
এছাড়া, তুরস্কের কৌশলগত গুরুত্বকে পশ্চিমা দেশগুলো ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর তুরস্কের এই অবস্থান বদলে গেছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আরেক মেয়াদের শাসনামলে তার দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে সেই সম্ভাবনা খুব কম। তবে আঙ্কারার কৌশলগত মিত্র দেশগুলো এই সরকারের ওপর যে এ বিষয়ে গভীর নজর রাখবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/