এস্তোনিয়ায় রুশ যুদ্ধবিমানের ওপর নজর রাখছে ন্যাটো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৩৬ এএম, ২৪ মে ২০২৩
ছবি সংগৃহীত

এস্তোনিয়ার আমারি বিমানঘাঁটির রানওয়ের ঠিক পাশে বিমান ক্রুদের বিশ্রাম নেওয়ার একটি ঘরে টিভিতে জনপ্রিয় মার্কিন সিরিজ ফ্রেন্ডসের পুরোনো সব এপিসোড চলছিল। ক্ররা টেবিলের ওপর পা তুলে, হাতে কফির মগ নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা আর গাল-গল্পে মশগুল ছিলেন।

হঠাৎ তাদের এক সদস্য খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠলো, কালিনিনগ্রাদ থেকে উড়ে একটি জোম্বি (ভুতুড়ে) উত্তরের দিকে যাচ্ছে। সাথে সাথেই বাকি ক্ররা উঠে দাঁড়িয়ে পাশের অপারেশন কক্ষের দিকে ছুটলো যেখানে ‌‘ন্যাটো সিক্রেট’ লেখা কম্পিউটার স্ক্রিনের ডিজিটাল ম্যাপে ক্রমাগত নানা তথ্য আসছে।

আরও পড়ুন: পরবর্তী মহামারির জন্য সতর্ক করলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

এই বাহিনীর নাম ‘কুইক রেসপন্স ফোর্স ফর অপারেশন এ্যাজোটাইজ।’ ন্যাটো জোটের উত্তর-পূর্বের আকাশসীমা পাহারা দেওয়া এই ইউনিটের কাজ। আর ন্যাটোর এই সীমান্তে নিয়মিত রুশ যুদ্ধবিমান দেখা যায়।

এপ্রিল মাসে জার্মানির রিখতোফেন স্কোয়াড্রনের কাছ থেকে এস্তোনিয়ার এই বিমানঘাঁটির দায়িত্ব নেয় ব্রিটিশ বিমান বাহিনী আরএএফ-এর টাইফুন যুদ্ধবিমানের নবম স্কোয়াড্রন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর থেকে ন্যাটো সামরিক জোট তাদের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত রক্ষার তৎপরতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

তাদের লক্ষ্য একটাই- রাশিয়া যেন অন্য কোনো দেশে, বিশেষ করে ন্যাটো জোটের বাল্টিক অঞ্চলের তিনটি দেশ (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া) বা পোল্যান্ডে একইরকম হামলা চালানোর সাহস না করে।

সীমান্তের আকাশে সন্দেহজনক রুশ যুদ্ধবিমানকে ন্যাটোর এই বিমানঘাঁটির ক্ররা বলে ‘জোম্বি’বা ভুতুড়ে। এটি তাদের কোড-নেম। এক্ষেত্রে যে কোনো তিনটি সম্ভাব্য বিষয় দেখা দিতে পারে বলে রুশ যুদ্ধবিমানের তৎপরতা সম্পর্কে বলেন আরএএফ-এর উইন্ড কম্যান্ডার স্কট ম্যাকল। হয় সেগুলো তাদের ফ্লাইট-প্ল্যান আগে থেকে জানায় না অথবা তারা কোনো ধরনের যোগাযোগ করে না অথবা আমাদের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের পাঠানো কোনো বার্তার কোনো জবাবই দেয় না।

আমারি বিমানঘাঁটির কাছের আকাশে সেদিন যে রুশ বিমানটির দেখা মিললো সেটি ন্যাটো সীমান্তের উল্টোদিকে উত্তরে উড়ে গেছে। এস্তোনিয়ার এই বিমান-ঘাঁটিটি শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত বিমান বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। কাছের একটি জঙ্গলে রয়েছে নিহত সোভিয়েত পাইলটদের একটি কবরস্থান।

এখানে মোতায়েন ন্যাটো পাইলটদের কাজ বেশ জটিল এবং ২৪ ঘণ্টাই তাদের সজাগ থাকতে হয়। ফিনল্যান্ড যোগ দেবার পর বাল্টিক সাগর সীমান্তে এখন ন্যাটো জোটের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭য়ে। সুইডেন এখন যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়ার ভেতর রয়েছে। তা সম্পন্ন হলে সংখ্যা দাঁড়াবে ৮য়ে।

কিন্তু বাল্টিক অঞ্চলে এখনও রাশিয়ার দুটো শক্ত ঘাঁটি রয়েছে, পূর্বে সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার মাঝে রুশ ভূখণ্ড কালিনিনিগ্রাদ যেখানে রাশিয়া ব্যাপক সংখ্যায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে।

এই দুই ঘাঁটির মধ্যে রাতদিন রুশ এসইউ ২৭ যুদ্ধবিমান, সামরিক কার্গো বিমান, গোয়েন্দা বিমান যাতায়াত করে। ফলে ন্যাটো জোটের বিমান বাহিনী সর্বক্ষণ তটস্থ থাকে।

তরুণ টাইফুন পাইলট নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, আমরা হয়তো টেবিলের ওপর পা তুলে কফি খাচ্ছি, কিন্তু পরের মিনিটেই হয়তো অ্যালার্ম বেজে উঠলো। তিনি বলেন, অ্যালার্ম বাজলেই আমরা সাথে সাথে সাড়া দেই। মনে করি সত্যিকারের বিপদ এসেছে। আমরা বিমানের দিকে দৌড়ে যাই, পোশাক আশাক পরে ফেলি। ইঞ্জিন চালিয়ে দেই, রেডিওতে অপারেশন কন্ট্রোলের সঙ্গে কথা বলে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে ফেলি। তারপর যত দ্রুত সম্ভব উড়াল দেই।

হ্যাঙ্গারের ভেতর রাখা একটি টাইফুনের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল বিমানটি সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত যাতে দরকার পড়লেই লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। উইং কম্যান্ডার রিক লিস্ক ওই বিমানের সঙ্গে যুক্ত লম্বাটে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে আঙ্গুল তাক করলেন। তিনি বলেন, এটা মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১৮ সালে এটি বিমান বাহিনীতে যুক্ত করা হয়। এর মাথায় রাডার যুক্ত করা। লেজের দিকে নিজস্ব ক্ষেপণান্ত্র বা প্রপালশন।

বিমানটির ডানায় আরো ছোটো আকারের কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র জোড়া যেগুলো দিয়ে আকাশে শত্রু বিমানের সঙ্গে ডগ-ফাইট করা যায়। আকাশে রুশ বিমানের কাছাকাছি এসে পড়লে তখন কী হয়? কী করেন তারা? উইং কম্যান্ডার ম্যাকল এর জবাবে বলেন, এখানে আমাদের কাজ ন্যাটো জোটের আকাশসীমার সুরক্ষা। আরও বলেন, শত্রুকে মোকাবিলার কৌশল একটি গোপন বিষয়।

তবে আরেকজন পাইলটের জবাব ছিল কিছুটা খোলামেলা। তিনি বলেন, আমরা জানি না ঠিক কোন বিমানের মুখোমুখি আমরা হবো। সুতরাং আমরা পাশাপাশি উড়তে থাকি। বোঝার চেষ্টা করি এই বিমানটি কী এবং কাদের। তারপর অপারেশন সেন্টারের সাথে কথা বলি। তারা যে নির্দেশ দেয় সে অনুযায়ী কাজ করি।

এই আরএএফ পাইলটরা রুশ বিমানগুলোর কাছাকাছি হলে সেগুলোর ছবি তোলে, যতগুলো সম্ভব ছবি তোলে। যুদ্ধবিমান তাড়াতে আমরা মোট আটটি মিশন করেছি- বলেন উইং কম্যান্ডার ম্যাকল। সবগুলোই ছিল রুশ বিমান...আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে বাল্টিক অঞ্চলে ন্যাটো আকাশসীমায় রুশ যুদ্ধবিমানের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর কাজে জড়িত, কিন্তু সন্দেহ নেই যে গত বছর ইউক্রেনে রুশ হামলার পর এখানকার পরিস্থিতি বদলে গেছে।

শুধু আকাশে নয়, স্থলে মোতায়েন সৈন্য সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী কাজা কালাস বলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি ইউক্রেনে সফল হন, তাহলে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি এরপর বাল্টিক দেশগুলোর দিকে নজর দেবেন।

ন্যাটো জোট রাশিয়ার সাথে তাদের সীমান্তে বাড়তি নিরাপত্তার নীতি অনুসরণ করে। তারই অংশ হিসেবে এস্তোনিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় তাপায় ব্রিটিশ নেতৃত্বে বহুজাতিক একটি বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। তাদের কাছে রয়েছে চ্যালেঞ্জার টু ট্যাঙ্ক এবং মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম (এমএলআরএস), ওয়াইল্ড ক্যাট এবং অ্যাপাচে হেলিকপ্টার।

আরও পড়ুন: এখনো করোনাভাইরাসে প্রতি চার মিনিটে একজনের মৃত্যু

তাদের মূল লক্ষ্য রাশিয়া যেন এখানে হাত বাড়ানোর সাহস না পায়। এস্তোনিয়ায় মোতায়েন ব্রিটিশ বাহিনীর কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাইলস হ্যারিস বলেন, বাল্টিক অঞ্চলে ন্যাটোর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উত্তেজনা এড়িয়ে রাশিয়াকে ঠেকিয়ে রাখা।

তবে সীমান্তের ওপারে রাশিয়া যত সৈন্য জড় করতে পারবে সে তুলনায় এখানে ন্যাটো বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অনেক কম। রাশিয়া যদি কখনো পশ্চিমের দিকে এগোয় তাহলে ন্যাটোকে এখানে দ্রুত প্রচুর সৈন্য পাঠাতে হবে।

কিন্তু ন্যাটোর কি সেই সংখ্যায় সৈন্য পাঠানোর ক্ষমতা রয়েছে? ব্রিগেডিয়ার হ্যারিস বলেন, বাল্টিক অঞ্চলে বর্তমানে মোতায়েন ন্যাটো বাহিনী রাশিয়াকে নিরস্ত রাখতে যথেষ্ট। যদি তাতে কাজ না হয়, তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। যদি রাশিয়া আগ্রাসন চালায়, আমরাও পূর্বদিকে এগুবো এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো।

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।