দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির মডেল কি থমকে যাচ্ছে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৪৩ পিএম, ০৫ মার্চ ২০২৩

উন্নয়নের সুপারস্টার বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই সমালোচনাকারীদের বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই করে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। সে সময় ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্যসংকট, দুর্ভিক্ষও হওয়ার শঙ্কা নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে হ্যাঁ সূচক প্রশ্নের জবাবে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সঙ্গে সেই তকমা লেগে যায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বহুল জনসংখ্যা, দারিদ্র্যতা, ভঙ্গুর অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাবিধ কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটি। অবশেষে বাংলাদেশ ২০২১ সালে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ, মিতব্যয়ী সামাজিক উন্নয়নের রোল মডেল ও দক্ষিণ এশিয়ার অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক যোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষ উদযাপন করেছে।

বাংলাদেশের এমন অগ্রগতির জন্য দেশটির কর্ণধাররা অবশ্য প্রশংসিত হন। দীর্ঘদিন ধরে প্রগতিশীল সামাজিক নীতি গ্রহণ করেছে দেশটির সরকার। বিশেষ করে নারী ও কন্যাশিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে নারীদের। সামাজিক উন্নয়নের সূচকে ভারত, পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে গার্মেন্টস শিল্প। যেমনটি আমরা ব্যাখ্যা করি, করোনা মহামারি আঘাত হানার আগে, দশ বছরে বাংলাদেশ বার্ষিক ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চীনের যেখানে ৮ শতাংশ। বাজার মূল্যে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি, প্রায় আড়াই হাজার ডলার, যা ভারতের চেয়ে বেশি। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের তালিকায় স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার কথা। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রশংসনীয় উদ্যোগ বাংলাদেশের।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, তবে সেই সম্ভাবনার জায়গাগুলো কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন। ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয়, স্বল্প মূলধন ও অর্থ সরবরাহে ভারসাম্যের চাপ অনেক উন্নয়নশীল দেশকে জটিলতায় ফেলেছে। এমন পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটাপন্ন পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মতো সঙ্কুচিত নয়। তবে মানদন্ড ধরে রাখা দরকার।

দ্য ইকোনমিস্টের পরামর্শ, বাংলাদেশের অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে হবে। যদিও সমস্যাগুলো কাঠামোগত এবং রাজনৈতিক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে এবং যা অবনতির গুরুতর ঝুঁকিতেও রয়েছে।

Bangladesh-2.jpg

বাংলাদেশের অর্থনীতি তৈরি পোশাক খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল, যা মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ। শিগগির স্বল্পোন্নত অবস্থার সঙ্গে যুক্ত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য শর্তাদি হারাতে পারে বাংলাদেশ। তবে ফার্মাসিউটিক্যালস ও ইলেকট্রনিক্সের মতো উচ্চমূল্য সংযোজিত শিল্পে বৈচিত্র্য আনার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অপ্রতিরোধ্য। যদিও দুর্নীতি, বিধিনিষেধ, ক্রেডিট পেতে অসুবিধাসহ নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হয় এসব শিল্প।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন। তিনি জাতির পিতা ও বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্র স্পর্শ করেছেন তিনি।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, চাকরি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য বেড়েছে। বিগত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের রেটিংয়ে অবনতি হয়েছে দেশটির। আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার শঙ্কাও রয়েছে।

শক্তিশালী সরকারের প্রতি, ৭৫ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অযৌক্তিক নয়। ২৯টি সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টাসহ বাংলাদেশ বহু বার অস্থিতিশীলতার ছোবলে পড়ে। আরও টেকসই শাসনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এমনকি তার পরিবারের উত্তরাধিকার ও সম্ভবত এটি সুরক্ষার জন্য হলেও। দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির ভিত্তি হবে এমন স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুদ্ধার করাও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, পশ্চিমা সরকারগুলো চাপ প্রয়োগ করতে অনিচ্ছুক। তবে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে সতর্ক তারা। দেশটির উচ্চবিত্তদের অনেকেই পশ্চিমের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ভালোভাবে দেখে। বিশেষ করে ব্যবসার সুযোগ থেকে শুরু করে তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে। বাংলাদেশ অতীতের তুলনায় বিদেশি পুঁজির ওপরও বেশি নির্ভরশীল।

বৈশ্বিক উষ্ণ জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশেরও পরিবেশগত হুমকি বাড়ছে। বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, তাপমাত্রা ১ দশকি ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এক তৃতীয়াংশ কৃষি জমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের বিপর্যয় একটি তীব্র সংবেদনশীল অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। সেই ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশের আরও উন্নয়নমূলক অগ্রগতি দরকার।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এসএনআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।