রয়টার্সের প্রতিবেদন
ভূমিকম্পের পর তুরস্কে সিরীয় শরণার্থীবিরোধী মনোভাব বাড়ছে
সিরীয় শরণার্থীদের বিরুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে চুরি ও লুটপাটের অভিযোগ তুলেছেন একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা। তাদের দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম ও শহরগুলোতে টিকে থাকা বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত দোকান-বাড়িঘর থেকে বিভিন্ন জিনিস চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন শরণার্থীরা।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ভয়াবহ ভূমিকম্পে এমনিতেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তুরস্কের হাজার হাজার বাসিন্দা। তার মধ্যে চুরির ঘটনায় সিরীয় শরণার্থীদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে তুর্কি জনগণের মধ্যে। এরই মধ্যে অনেকের মধ্যে শরণার্থীবিরোধী মনোভাব দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন>> ভয়াবহ ভূমিকম্প সামলাতে কতটা প্রস্তুত ইস্তাম্বুল?
এরই মধ্যে টুইটারে ‘সিরীয়দের চাই না’, ‘আর তাদের স্বাগত নয়’, ‘শরণার্থীদের ফেরত পাঠাও’, এমন সব স্লোগান দিতে দেখা গেছে অনেক তুর্কি নাগরিককে। সিরীয় শরণার্থীদের দাবি, ভূমিকম্পের পর জরুরি শিবিরগুলো থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাদের।
এক তুর্কি নাগরিক টুইটারে লেখেন, ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়াদের এক বছরের জন্য আমার আঙ্কারার বাড়িতে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে শর্ত হলো, তারা কেউ সিরীয় হতে পারবে না। এ ব্যক্তির মতো ত্রাণ বা অস্থায়ী আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া অন্যদের শর্তও একধরনের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক তুর্কি নাগরিক ভূমিকম্প দুর্গতদের সহযোগিতার কথা বলছেন। তাদের বক্তব্যেও খোলামেলা সিরীয় শরণার্থী বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়।
গাজিয়ানতেপ শহরের দন্তচিকিৎসক আহমেতের দাবি, সিরীয় শরণার্থীরা খালি ব্যাগ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ঘুর ঘুর করছেন। আর সুযোগ পেলেই দোকান ও ধ্বংসস্তূপ থেকে অনেক জিনিসপত্র তাদের ব্যাগে ভরে নিচ্ছেন। এখানে বেশ কয়েকটি লুটের ঘটনা ঘটেছে, যা শরণার্থীরাই করেছেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বদেশিদের জন্য তুরস্কের মেরসিন শহরে একটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছেন সিরিয়ার সাবেক সরকারবিরোধী রাজনীতিক মুস্তাফা আলি। তিনি বাস্তুচ্যুত তুর্কিদের কাছ থেকে এ সিরীয়দের আলাদা রাখার বিষয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে একমত।
আরও পড়ুন>> শেষ হতে চলেছে তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পের উদ্ধার পর্ব
মুস্তাফা আলি বলেন, আমরা উদ্ধার অভিযান চলছে এমন জায়গাগুলোতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ, লোকজন যখনই আমাদের নিজের ভাষায় কথা বলতে শুনছেন, তখনই চিৎকার করে তেড়ে আসছেন ও ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
‘তুরস্কের বাসিন্দারা লুটপাটের জন্য আমাদের দায়ী করছেন। এসব অভিযোগ আসলে মিথ্যা। এর মাধ্যমে শুধু বিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে। দুই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ আলাদা। তাই এ মুহূর্তে দুই পক্ষকে আলাদা রাখলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।’
মুস্তাফা আলির আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত বিলাল আল-শেখ (৩৫) নামের এক যুবক বলেন, প্রথমে আমরা একটি যৌথ আশ্রয়কেন্দ্রে দুদিন ছিলাম। দ্বিতীয় রাতে কয়েকজন লোক এসে বললেন, সিরীয়দের অন্য আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ঘুরে ঘুরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে আমাদের ঠাঁই মেলেনি, অবেশেষে এখানে এসেছি।
আরও পড়ুন>> ধ্বংসস্তূপের নিচে দিনের পর দিন মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে?
এর আগে রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) তুরস্কের বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে লুটপাটের অভিযোগে ৪৮ জনকে আটক করার কথা জানায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। অনেক এলাকার বাসিন্দা ও ত্রাণকর্মীরা ব্যাপক লুটপাট হয়েছে বলে জানান। নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কথা জানিয়ে একাধিক বিদেশি ত্রাণ সরবরাহকারী তাদের কাজ স্বল্প সময়ের জন্য বন্ধ রাখে।
আটক হওয়া দুজন নিজেদের ত্রাণকর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। অভিযোগ উঠেছে, তারা দক্ষিণ হাতায় প্রদেশে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আসা ছয় ট্রাকভর্তি খাবার লুট করার চেষ্টা করেছিলেন।
শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেন, এ মহাবিপর্যয়ের মধ্যে কেউ অরাজকতা করার চেষ্টা করলে, তাদের আটক করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
আরও পড়ুন>> তুরস্কে বিধ্বস্ত এলাকায় লুটপাটের অভিযোগ, আটক ৪৮
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশ ছেড়ে আসা শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিল তুরস্ক। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ৪০ লাখ সিরীয় শরণার্থী বসবাস করছেন। তাদের অধিকাংশই তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে সিরিয়া সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বসবাস করেন।
জানা যায়, ভূমিকম্পে তুরস্কের যেসব শহর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গাজিয়ানতেপ তার মধ্যে অন্যতম। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ওই শহরে প্রায় ৫ লাখ সিরীয় শরণার্থী বাস করেন, যা শহরটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
রয়টার্স বলছে, সিরীয়দের প্রতি তুর্কিদের ক্ষোভ নতুন নয়, কিন্তু ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে সিরীয় শরণার্থীদের রাখতে গিয়ে তুরস্কের অতিরিক্ত ৪ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ খরচ হয়েছে।
আরও পড়ুন>> ধসে পড়া ভবনগুলোর পরতে পরতে জীবনের চিহ্ন
অনেক তুর্কি নাগরিকের দাবি, সিরীয় শরণার্থীদের শ্রম তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় চাকরি ও সেবাখাত থেকে বিভিন্নভাবে বঞি্চত হচ্ছেন তারা। বলা হচ্ছে, সিরীয় শরণার্থীদের বিষয়টি চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে।
৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় ভোরে হওয়া ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ও শত শথ আফটারশকে তুরস্ক-সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা এরই মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজার হয়েছে। এক সপ্তাহ পর কাউকে জীবিত উদ্ধারের আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। তাই নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্র: রয়টার্স
এসএএইচ