তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প

ধসে পড়া ভবনগুলোর পরতে পরতে জীবনের চিহ্ন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৩৩ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

সাত দশমিক আট ও সাত দশমিক ছয় মাত্রার ‍দুটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্কে নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে, একই ঘটনায় সিরিয়ায় মারা গেছেন প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ। গত কয়েকদিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী পুরোদমে উদ্ধারকাজ চালালেও, আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে উদ্ধার অভিযানের গতি।

প্রথমদিকে অনেককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, সময় যত গড়িয়েছে জীবিত উদ্ধারের আশা ততই কমেছে। ভূমিকম্প আঘাত হানার দেড়শো ঘণ্টা পার হয়েছে। এতক্ষণ ধরে খাবার-পানি ছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকা অলৌকিক ছাড়া আর কিছুই না। তাই উদ্ধারকারীরা বলছেন, এখন শুধু মরদেহই পাওয়া যাবে। যদিও, সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) মোস্তফা সারিগুল (৩৫) নামের এক যুবককে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন>> ৬ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে একজনকে জীবিত উদ্ধার

jagonews24

আভসারোগলু নামের এক উদ্ধারকর্মী বলেন, তুরস্কের প্রাচীন শহর আন্তাক্যাতে ধসে পড়া অ্যাপার্টমেন্টের নিচে চাপা পড়েছিল আমার বোন, তার স্বামী ও তাদের দুই সন্তান। মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাত পর্যন্ত তারা জীবিত ছিল। কিন্তু ধ্বংসস্তূপের গভীরে থাকা একটি জেনারেটর থেকে আগুন লাগার পর তাদের আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

কান্না করতে করতে আভসারোগলু বলেন, পাঁচ দিন পর রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) ভবনটির অবশিষ্টাংশ সরিয়ে আমার বোন ও তার পরিবারের সদস্যদের মরদেহ বের করে আনার চেষ্টা করি। কিন্তু মরদেহ তো দূরের কথা, তাদের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাইনি। সম্ভবত তারা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আগুন লেগে যাওয়া ব্লকটিতে প্রায় ৮০ জন বাস করতেন। তাদের মধ্যে আগুন লাগার আগে ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়। পরে ১২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কিছু মরদেহের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, সেগুলোর হাড় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন>> ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যেভাবে উদ্ধার হলো দুই বোন

ভূমিকম্পে ধসে পড়া বেশ কয়েকটি ভবনেই এমন আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। সেসব ভবনের নিচে চাপা পড়া মানুষগুলোর অবস্থাও হয়তো একই রকম। হাড় ছাড়া হয়তো তাদের শরীরের আর অংশই অবশিষ্ট থাকবে না।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা বলছে, ঐতিহাসিকভাবে অ্যান্টিওক নামে পরিচিত তুরস্কের হাতায়া প্রদেশের প্রাচীন শহর আন্তাক্যায় ধসে পড়া ভবনগুলো দেখে ধ্বংসের মাত্রা বোঝা কঠিন। ভয়াবহ ভূমিকম্প শহ শত শত আফটার শক সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় প্রতিটি ভবনেই রয়েছে বড় বড় ফাটল, কিছু ভবনের অর্ধেকটা টিকে আছে, আবার কোনোটা ঝুঁকিপূর্ণভাবে হেলে পড়েছে।

jagonews24

অর্ধেক ধসে পড়া ভবনগুলোর দেয়াল যেন মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া প্রাণগুলোর অস্তিত্ব প্রকাশ করে। এসব ভবনের প্রায় প্রতিটিতেই ভাঙা কংক্রিট ও পেঁচানো রডে বেঁধে থাকা আসবাবপত্র, হাস্যোজ্জ্বল পরিবারিক ছবির অ্যালবাম, জামাকাপড় ও খোলা আলমারি চোখে পড়ে। কত হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা এক ছাদের নিচে ভাগাভাগি করেছেন মারা যাওয়া মানুষগুলো। এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। জীবন কতটা অনিশ্চিত, এ ভবনগুলো যেন তা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন>> তুরস্কে ভূমিকম্প/ একদিনে পাঁচ মরদেহ উদ্ধার করলো সেনাবাহিনীর বিশেষ উদ্ধারকারী দল

আন্তাক্যায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ভারতীয় দলের এক উদ্ধারকারী বলেন, চারদিন ধরে আমরা শুধু মরদেহই উদ্ধার করছি। এখন পর্যন্ত একজন জীবিত মানুষকে খুঁজে পাইনি। আমরা জীবিত কাউকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তা আর সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

পাশের রাস্তায় এক নারীকে ভারাক্রান্ত মুখে মাটিতে শুইয়ে রাখা লাশের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। চোখে-মুখে তার রাজ্যের চিন্তা। বিড় বিড় করে বলতে থাকেন, নিজেকে ঠিক রাখতে হবে, নিজেকে ঠিক রাখতে হবে।

স্থানীয় এক টেক্সটাইল দোকানের মালিক সেরিজান আগবাস বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর এখানে কাজ করেছি। আমার দোকানটি এখন পাঁচতলা ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ভবনে অবস্থানরত প্রায় ১০০ জন। আমার বাড়িটা অবশ্য ঠিক রয়েছে। কিন্তু চোখের সামনে শহরজুড়ে যে দৃশ্য দেখছি, তাতে নিজেকে ঠিক রাখা কঠিন।

আরও পড়ুন>> তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প/ ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণে জড়িতদের বিরুদ্ধে ১১৩ পরোয়ানা জারি

আগবাস ও তার কিছু প্রতিবেশী বলেন, এখন আমাদের তাঁবু ও অন্যান্য সহায়তা প্রয়োজন। বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মানসিক সমর্থন দরকার। আমরা সরকারের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করছি না, নিজেদেরকেই সব ঠিক করতে হবে।

এদিকে, তুর্কি সরকার জোর দিয়ে বলেছে, ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের প্রভাব প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ মানুষের ওপর পড়েছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এক বছরের মধ্যে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকা পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

দেশটির দুর্যোগ ও জরুরি সেবা সংস্থা এএফএডি বাস্তুচ্যুতদের থাকার জন্য আন্তাক্যা শহরের বাইরে তাঁবুর ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে, সিরিয়ান শরণার্থীদের স্থানীয় ফুটবল স্টেডিয়ামে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শহরের বাইরে একটি প্রদর্শনী কেন্দ্রে ২৬টি বিদেশি ও তুর্কি সংস্থা ত্রাণ সহায়তা সরবরাহের কাজ করছে।

আরও পড়ুন>> তুরস্কে বিধ্বস্ত এলাকায় লুটপাটের অভিযোগ, আটক ৪৮

সূত্র: আল-জাজিরা

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।