দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ

একনায়কতন্ত্রের দ্বারপ্রান্তে তুরস্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০০ পিএম, ২১ জানুয়ারি ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটোর মধ্যে তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনী হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশটি অশান্ত প্রতিবেশি দেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ায়। সম্প্রতি দেশটি পশ্চিম বলকান, পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। সর্বোপরি, এটি কৃষ্ণ সাগর ঘিরে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গত বছর তুরস্ক ক্ষুধার্ত বিশ্বে ইউক্রেনীয় শস্য পাঠানোর ব্যাপারে জাতিসংঘের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিল। তুরস্কের সাধারণ নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। ২০২৩ সালেই নির্বাচন হচ্ছে দেশটিতে। এবারের নির্বাচন ঘিরে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ানের ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছে দ্য ইকোনমিস্ট।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বহিরাগতদের তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান আভাস দিয়েছেন, আগামী ১৪ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নির্বাচন। অনিয়মিত প্রেসিডেন্টের কারণে দেশটি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আচরণ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

আরও পড়ুন> তুরস্কের শতবর্ষে এরদোয়ান যুগের সমাপ্তি ঘটতে পারে

২০০৩ সালের মার্চ মাসে যখন এরদোয়ান দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তুরস্কের জন্য তিনি প্রতিশ্রুতির ডালি নিয়ে বসেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ভয় ছিল, তার একটি অতিমাত্রায় ইসলামপন্থি এজেন্ডা ছিল, কিন্তু তিনি ও তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টি এটি অনুসরণ করতে পারেননি। এরদোয়ানের ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রথম কয়েক বছর তার সরকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছে যেটি কয়েক দশক ধরে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি সেই জেনারেলদের প্রতিহত করেছিলেন যারা প্রায়ই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন এবং অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালান। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তিনি সংস্কার পথ বেছে নেন। এমনকি তিনি তুরস্কের সবচেয়ে বড় জাতিগত সংখ্যালঘু কুর্দিদের কাছে শান্তির অনুভূতিও প্রকাশ করেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর হাতে নিপীড়নের শিকার হন। ২০০৫ সালে তার বড় অর্জন যা তার সমস্ত পূর্বসূরীরা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়ে আলোচনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যতবেশি ক্ষমতায় থাকছেন তার ততবেশি ‘স্বৈরাচারী’ মনোভাবও বেড়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১১ বছর পর তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং সেই আগের দুর্বল পদটিকে একটি প্রভাবশালী পদে পরিণত করতে শুরু করেন। ২০১৬ সালে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর তিনি কয়েক হাজার লোককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। এই চক্রান্তের জন্য দায়ী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগের নিছক অজুহাতে গ্রেফতারও করা হয় অনেককে। এই ইস্যুতে দ্য ইকোনমিস্টের বিশেষ প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, তিনি অবিচ্ছিন্নভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন এবং চেক ও ব্যালেন্স নষ্ট করেছেন। তিনি অনেক গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রীয় প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন। তিনি কার্যত ইন্টারনেট সেন্সর করেছেন। তিনি বিরোধী নেতাসহ অনেক সমালোচককে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। তিনি একে পার্টির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন, আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধীদের হয়রানি করেন বলেও অভিযোগ আছে।

এরদোয়ান ক্ষমতার তৃতীয় দশকের কাছাকাছি এসে তার ক্রমবর্ধমান উদ্ভট ধারণা দ্রুত জনসাধারণের নীতিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে, তিনি পূর্বে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর একটি আর্থিক তত্ত্ব চাপিয়েছেন যা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। তিনি মনে করেন মুদ্রাস্ফীতির প্রতিকার হলো অর্থ সস্তা করা। তুর্কি মুদ্রাস্ফীতি ৬৪ শতাংশ হওয়ার এটাই প্রধান কারণ ছিল। ফলে দেশটিতে জীবনযাত্রার মান সংকুচিত হচ্ছে এবং উত্তেজনা বাড়ছে। বিশেষ করে শহরগুলোতে ভোটাররা পিছিয়ে পড়ছেন।

৩ বছর আগে এরদোয়ানের দল তিনটি বৃহত্তম শহর আঙ্কারা, ইস্তাম্বুল এবং ইজমিরে মেয়র নির্বাচনে হেরে যায়। বিভিন্ন জরিপ বলছে, তিনি চার মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্টের পদ হারাতে পারেন, যদি বিরোধীরা তার সেরা প্রার্থীর পেছনে একত্রিত হয় এবং নির্বাচন কমবেশি স্বচ্ছ হয়।

তবে এটি একটি বড় যদি। কেননা এরদোয়ান অসম ক্ষেত্রটিকে তার বাগে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগ্লু, সম্ভবত এরদোয়ানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। সম্প্রতি কারাগারে গেছেন তিনি এবং রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের যারা তার প্রথম মেয়র বিজয় বাতিল করেছে তাদের ‘মূর্খ’ বলার জন্য তার এ সাজা। সরকার সাংবিধানিক আদালতকে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি) বাতিল ঘোষণা করতে বলেছে। এটি কুর্দিদের বৃহত্তম দল, যাদের অনেক নেতা এখন কারাগারে বন্দী। আদালত এইচডিপির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেন। দেশটির এই প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে বিরোধীদের কুর্দি ভোটারদের সমর্থন প্রয়োজন হবে।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একবার গণতন্ত্রকে একটি ট্রাম যাত্রার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি যখন আপনার গন্তব্যে পৌঁছাবেন, আপনি নামবেন। বলা হচ্ছে, তার অধীনে নির্বাচন খুব কমই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যদিও বিপুল সংখ্যক ভোটার অংশ নিয়েছে নির্বাচনে। এবার উদ্বেগের বিষয় হলো এরদোয়ান পরাজয়ের ভয়ে যদি উঠে দাঁড়ান এবং নির্বাচন সুষ্ঠু বা অবাধ হবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

আরও পড়ুন> শস্য রপ্তানি চুক্তি সক্রিয় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তুরস্ক

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, পশ্চিমা নেতাদের কথা বলা দরকার। আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো প্রায়শই এরদোয়ানের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকে কারণ সমস্যাগুলো এক হলেও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় আছে। কেউ চায় না তুরস্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ সম্পূর্ণ ‘দুর্বৃত্ত’ হয়ে যাক। সবাই অবগত যে একজন অসন্তুষ্ট, বিচ্ছিন্ন তুর্কি প্রেসিডেন্ট বড় ‘দুষ্টুমি’ করতে পারে। তিনি গ্রীস ও সাইপ্রাসের সঙ্গে ভয়ানক আঞ্চলিক ঝগড়া উসকে দিতে পারেন। সিরিয়ায় আরও বিভ্রান্তি ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি তুরস্কের ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ অভিবাসী বা শরণার্থীদের দক্ষিণ ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার অনুমতি দিতে পারেন। তিনি ন্যাটো সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের জন্য ন্যাটোতে যোগদানকে অবরুদ্ধ করে ইউক্রেনের পক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন।

আরও পড়ুন> রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব এরদোয়ানের

তবুও তুরস্কের পশ্চিমাদেরও প্রয়োজন, অন্তত দেশটির বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য। দেশটিকে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পুনরুজ্জীবিত করার একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতিক্রিয়ায় ভেঙে পড়েছে। তুরস্ক কম উৎপাদনশীলতা উন্নত করতে পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। এটি পশ্চিমা অস্ত্র চায়, বিশেষ করে আমেরিকান যুদ্ধবিমান। এরদোয়ান যদি গণতন্ত্রের দিকে ফিরে যান এবং স্বৈরশাসকদের ক্লাবে যোগদান করেন তবে এসব জিনিস কোনোটিই সুরক্ষিত হবে না। এই সব তাকে পশ্চিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য একটি শক্তিশালী প্রণোদনা দেয়।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পশ্চিমা নেতাদের দর কষাকষির ক্ষমতা দেওয়া উচিত। এরদোয়ান সম্প্রতি তার মধ্যপ্রাচ্যের অনেক প্রতিবেশি দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। পশ্চিমা নেতাদের তাই নির্বাচনের আগে ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রকাশ্যে ইমামোগ্লু ও এইচডিপির ওপর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলে এরদোয়ানকে দেখানো উচিত, তারা তার আচরণ সম্পর্কে কতটা সচেতন। এরদোয়ানকে প্রান্ত থেকে টেনে তুলতে দেরি হয়নি পশ্চিমাদের। তবে এখনই তাকে সতর্ক করা শুরু করতে হবে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এসএনআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।