গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসর মারা গেলেও অন্যরা বাঁচলো কীভাবে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:১২ পিএম, ০৬ জানুয়ারি ২০২৩
প্রতীকী ছবি

আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল একটি বিশালাকার গ্রহাণু। এতই প্রচণ্ড ছিল সেই আঘাত যে তার ফলে পৃথিবীর সব ডাইনোসর মারা গিয়েছিল। অথচ সেই ভয়ংকর ঘটনার মধ্যেও বেঁচে ছিল ছোট ছোট কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিন্তু কীভাবে?

এখনকার মেক্সিকো উপকূলে প্রচণ্ড গতিতে এসে আছড়ে পড়েছিল বিশাল আকারের গ্রহাণুটি। সেটি ছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার চওড়া এবং তা পৃথিবীকে আঘাত করেছিল ১০০ কোটি পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে।

এর আঘাতে বন-জঙ্গলে আগুন লেগে গিয়েছিল, সাগরে সৃষ্টি হয়েছিল সুনামি। বাতাসে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল বাষ্প হয়ে যাওয়া শিলা, ছাই আর ধুলো উঠে গিয়েছিল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কয়েক কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত।

পৃথিবীর বুকে তৈরি হয়েছিল মারাত্মক তাপ, বাতাস ভরে গিয়েছিল ছাইয়ে, নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার। চারদিকে পড়ে ছিল ডাইনোসররা। কেউ এরই মধ্যে মৃত, কেউ মৃতপ্রায়।

তখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে জীবিত প্রাণীদের জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে খারাপ দিন। কিন্তু তার মধ্যেই দেখা গেলো একটি ক্ষুদ্র প্রাণীকে। সে ওই নারকীয় ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই খাদ্যের সন্ধানে নেমেছে– একটি দু’টি পোকা ধরে খাচ্ছে, আবার ছুটে গিয়ে গর্তে আশ্রয় নিচ্ছে।

jagonews24

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মহাদুর্যোগ এসেছিল আগেও একবার এসেছিল ২৫ কোটি ২০ লাখ বছর আগে। এটিকে বলা হয় ‘গ্রেট ডাইং’ যুগ। তখন ৯৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণী ও ৭০ শতাংশ স্থলচর প্রাণী মারা গিয়েছিল। তবে এত আকস্মিকভাবে নয়, অনেক দিন ধরে।

কিন্তু ওই গ্রহাণুর আঘাতে বিশাল বিশাল ডাইনোসরসহ পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

তখন কেমন প্রাণীরা বাস করতো পৃথিবীতে?
ডাইনোসরদের যুগে পৃথিবীতে তারাই একমাত্র প্রাণী ছিল না। আরও বহু রকমের প্রাণী ও উদ্ভিদের বাসস্থান ছিল এই গ্রহ।

সেই গ্রহাণুর আঘাতের পরেও যারা মহাবিপর্যয়ে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। নাম পার্গাটোরিয়াস, দেখতে অনেকটা ছোট্ট কাঠবিড়ালি ও ছুঁচোর সংকরের মতো। একে বলা হয়, মানুষের জানা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো প্রাইমেট বা বানরজাতীয় প্রাণী।

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সারাহ শেলি বলছেন, সেই সময় পৃথিবীতে অনেক ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল, যারা ফল, বাদাম ও নানা ধরনের বীজ খেয়ে বাঁচতো।

jagonews24পার্গাটোরিয়াসকে মনে করা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাইমেট। ছবি সংগৃহীত

 

ছিল ডিডেলফোডন নামে এক ধরনের মাংসাশী প্রাণীও। এটি আকৃতি ছিল মোটামুটি একটি বিড়ালের সমান।

কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল পার্গাটোরিয়াস?
জীবজগতে পার্গাটোরিয়াসদের স্থান ছিল খানিকটা এখনকার যুগের ইঁদুরের মতো। এরা এবং মানুষের পূর্বপুরুষরা কীভাবে সেই মহাদুর্যোগ থেকে বেঁচে গিয়েছিল সেটি এক বিরাট প্রশ্ন।

এ নিয়েই ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড রেইন অব দ্য ম্যামলস’ নামে একটি বই লিখেছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিভ ব্রুসেট। তিনি ও তার সহকর্মীরা এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্রুসেট বলেন, ‘সেই দিনটি স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ সব প্রাণীর জন্যই ছিল খুব খারাপ দিন। এর আগের ৫০ কোটি বছরের মধ্যে এত বড় গ্রহাণু পৃথিবীতে আর আঘাত করেনি এবং তাতে স্তন্যপায়ীদের অবস্থাও প্রায় ডাইনোসরদের মতো হতে যাচ্ছিল।’

গ্রহাণুর আঘাতের পর দাবানলে পৃথিবীর বনভূমি সব পুড়ে যায়। আকাশ ভরে যায় ছাইয়ে। সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারছিল না এবং গাছের জন্য সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ব্রুসেটের কথায়, পৃথিবীর গোটা বাস্তুতন্ত্রই একটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। তাপমাত্রা প্রথমে বেড়ে গেলেও পরের ৩০ বছর ধরে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি নিচে নেমে গিয়েছিল।

এমন প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার জন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষুদ্র আকৃতি খুবই সহায়ক হয়েছে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক গবেষক অরনেলা বার্ট্রান্ড উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আফ্রিকান হাতির মতো বড় প্রাণীর বাচ্চা মায়ের পেটে থাকে ২২ মাস আর ইঁদুরের গর্ভসঞ্চার থেকে বাচ্চা প্রসব পর্যন্ত সময় লাগে মাত্র ২০ দিন। সে কারণে ছোট প্রাণীর পক্ষে প্রতিকূল সময়ে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করা সম্ভব।’

তাছাড়া ছোট আকারের প্রাণীরা প্রজনন সক্ষমতাও অর্জন করে দ্রুত। বিপরীতে একটি টি-রেক্স ডাইনোসরের প্রজননের বয়সে পৌঁছাতে লাগে ২০ বছর।

দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, মাটির নিচে বসবাস করা। শেলি বলেন, প্যালিওসিন যুগের এসব ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণী আধুনিক স্তন্যপায়ীদের মতো নয়। তাদের আকৃতি ছিল অদ্ভুত এবং এদের সঙ্গে মাটির নিচে গর্ত করে থাকা প্রাণীদের অনেক মিল পাওয়া যায়।

মাটির নিচে থাকার ফলে তারা গ্রহাণুর আঘাতে মাটির ওপর যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা এড়িয়ে থাকতে পেরেছে।

‘যা পাওয়া যায় তাই খাও’
গ্রহাণুর আঘাতের পর বেশিরভাগ জীবিত গাছপালাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফলে এই বিপর্যয়ের পর যেসব প্রাণী নির্দিষ্ট এক ধরনের খাদ্যের পরিবর্তে যা পাওয়া যায় তাই খাওয়া শুরু করেছিল, তারা টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যায়।

jagonews24জুরাসিক যুগের প্রাণী ভিলেভলোডন। ছবি সংগৃহীত

শেলি বলেন, ‘যেমন ডিডেলফোডন এমন কিছু প্রাণী শিকার করে খেতো তার সংখ্যা ছিল খুবই কম। অন্যদিকে, ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণীর পক্ষে খাদ্য ও জীবনধারায় পরিবর্তন আনা ছিল সহজ এবং এটি তাদের বিলুপ্তি ঠেকাতে সহায়ক হয়েছে।’

ব্রুসেটের মতে, কিছু পাখি ও স্তন্যপায়ী যেসব প্রাণী বীজ খেতো, তাদের জন্য সেই বিপর্যয়ের পরেও খাদ্যের অভাব হয়নি। কিন্তু টি-রেক্সের মতো প্রাণীর পক্ষে ফলের বীজ খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।

তিনি বলেন, ‘গ্রহাণুর আঘাতের পরেও এসব বীজ মাটিতে পড়ে টিকে ছিল। পরে যখন আবার সূর্যালোক পৃথিবীর বুকে পড়তে পারলো, তখন সেই বীজ থেকে আবার নতুন গাছ গজাতে শুরু করলো।’

স্তন্যপায়ীদের সংখ্যা ও আকার বৃদ্ধি
প্যালিওসিন যুগের পর ধীরে ধীরে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র আবার ক্ষতি কাটিয়ে উঠলো এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীরা ডাইনোসরের শূন্যস্থান পূরণ করতে শুরু করলো। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন, এ সময় স্তন্যপায়ীদের আকার বড় হতে শুরু করে। এটাই ছিল সে সময়কার বিবর্তন বা অভিযোজনের প্রধান প্রবণতা।

jagonews24ডাইনোসর বিলুপ্তির পর উদ্ভব হয় বড় তৃণভোজী প্রাণী হিরাশিয়াস (বামে) ও মাংসাশী প্রাণী আর্কটোসিয়ন (ডানে)। ছবি সংগৃহীত

এর একটি ছিল তৃণভোজী প্রাণী এক্টোকোনাস। মনে করা হয়, এরা হয়তো বর্তমানকালের গরু-ঘোড়ার মতো খুরওয়ালা প্রাণীদের সঙ্গে সম্পর্কিত। ডাইনোসর বিলুপ্তির কয়েক লাখ বছরের মধ্যেই এদের ওজন বেড়ে ১০০ কেজির মতো হয়ে যায়। ভৌগলিক দিক থেকে এটি খুবই কম সময়।

শেলি বলেন, সে সময়কার আরও কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে একই প্রবণতা দেখা যায়। ব্রুসেট বলেন, ‘ডাইনোসরের মতো লাখ লাখ বছর টিকে থাকা এত বিশাল আকারের প্রাণী এত অল্প সময়ের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াটা খুবই চমকপ্রদ। তারা নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি।’

পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাতের পুরো ব্যাপারটাই এত আচমকা ঘটেছে এবং তার ফলে এত বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে যে, গবেষকরা বলছেন, ব্যাপারটা তাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছে।

jagonews24এ যুগের গরু বা ভেড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাণী পেরিপ্টিকাস। ছবি সংগৃহীত

বার্ট্রান্ডের কথায়, ‘আমরা যে এই পৃথিবীতে রয়েছি তা একান্তই ঘটনাচক্রে। এমনও তো হতে পারতো যে, গ্রহাণুটা পৃথিবীতে আঘাত করলো না অথবা এটি পৃথিবীরই অন্য এক প্রান্তে সাগরের মধ্যে গিয়ে পড়লো। তাহলে কিন্তু এর ফলে প্রাণীজগতে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটতো, তা হতো একেবারেই অন্যরকম। আমি যখনই এ ব্যাপারটা ভাবি, তখন আশ্চর্য হয়ে যাই।’

তবে পৃথিবীতে আজ যে স্তন্যপায়ীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের দিক থেকে হয়তো যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। অন্য কিছু হলে হয়তো আজ তারা থাকতো না।

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।