বছরের শুরুতেই দেখা দিতে পারে তেল-গ্যাস সংকট
আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে খুব বাজেভাবে। বিশেষ করে, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও জ্বালানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী তেল-গ্যাস বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে জ্বালানির দাম আরও বাড়তে পারে। আর এতে বিপাকে পড়তে পারে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও সাধারণ ভোক্তারা।
অনেকে বলছেন, করোনা মহামারি চলাকালে মানুষের চাহিদায় পরিবর্তন ও নতুন উৎপাদনে কম বিনিয়োগের ফলে জ্বালানি বাজারে আগেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এখন যুদ্ধের ফলে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে ও ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
তবে ইউরোপীয়দের দাবি, জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হলেও চলতি শীতে মৌসুম পার করতে পর্যাপ্ত জ্বালানি, অর্থাৎ গ্যাস সংগ্রহ করে রেখেছে তারা। কিন্তু যুদ্ধ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী শীতে পুরো ইউরোপে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। তাতে বিপাকে পড়বেন এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ। কমে যাবে শিল্পোৎপাদন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৩ সালে জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল থাকার পেছনে তিনটি বিষয় কাজ করতে পারে। প্রথমত, বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তাতে সাধারণ ভোক্তাদের আয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কমবে জ্বালানি তেলের চাহিদাও।
অনেকে আবার বলছেন, বছরটিতে অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে পেট্রোলিয়ামের বাজার। ইউরোপ যদি চলতি মাসে সমুদ্রপথে রাশিয়ার তেল বয়কট কার্যকর করে, তাহলে চীন ও ভারত পুতিন প্রশাসনের কাছ থেকে ২০২২ সালের তুলনায় অনেক বেশি জ্বালানি কিনতে শুরু করবে। এর মাধ্যমে দেশ দুটি নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি সংগ্রহের রাখার পাশাপাশি রাশিয়ার বাজার টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
আবার, যেহেতু ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র এখন জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যের বিশাল অংশ আমদানি করছে এশিয়া থেকে, সেক্ষেত্রে নতুন প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পেট্রোলিয়ামের রিজার্ভ না বাড়ানো ও এ সংক্রান্ত কার্যক্রমে বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
এদিকে, বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া লিবিয়ার মতো জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশগুলো দীর্ঘদিন পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন ধরে রাখতে পারবে না। অর্গানাইজেশন অব প্রেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো এরই মধ্যে জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
দ্বিতীয় উদ্বেগের বিষয় হলো, ডিজেল, পেট্রলের মতো পরিশোধিত তেলের ক্রমবর্ধমান সংকট। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া থেকে এ জাতীয় জ্বালানি আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করবে ইউরোপ। কিন্তু এর মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলো যে অন্যান্য দেশ থেকে পর্যাপ্ত অপরিশোধিত তেল কিনতে পারবে, তা নয়।
চীন ও ভারতের মতো দেশ, যাদের পর্যাপ্ত শোধনক্ষমতা রয়েছে, তারা নিজেদের চাহিদা পূরণ ও মজুত বাদ দিয়ে ইউরোপের জন্য তেল পরিশোধন করবে না। অন্য ক্রেতারা আরও দূরে। ফলে ইউরোপকে অপরিশোধিত জ্বালানির সরবরাহ ধরে রাখতে চাপে পড়তে হবে।
ইউরোপের এ সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, ডিজেল তৈরির জন্য অপরিহার্য উপাদান হাইড্রোজেনের অপ্রতুলতা। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ব্যয়বহুল এই গ্যাস প্রচুর পরিমাণে কিংবা ইচ্ছামতো উৎপাদনের সক্ষমতা নেই ইউরোপের দেশগুলোর।
সব দিক বিবেচনা করলে, নীতিগতভাবে রাশিয়ার পরে একমাত্র চীনই পারে প্রচুর পরিমাণে তেলজাতীয় পণ্য রপ্তানি করতে। খুব শিগগির শি জিনপিংয়ের দেশ প্রচুর পরিমাণে পরিশোধন শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কিন্তু চীনের ক্ষেত্রেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে শীতকাল। শীতে নিম্ন তাপমাত্রার ফলে চীনের নিজস্ব জ্বালানির মজুত কমে যেতে পারে, যা তাদের জ্বালানি রপ্তানি প্রবণতাকে সীমিত করতে বাধ্য করবে। ফলে ২০২৩ সালের মার্চ মাসের আগেই বিশ্বব্যাপী ডিজেলের সংকট দেখা দিতে পারে।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ২০২৩ সালে ইউরোপসহ পুরো বিশ্বের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে গ্যাস সংকট। যেহেতু রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারছে না, তাই স্বাভাবিকভাবেই পুতিন প্রশাসন মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি, তীব্র জ্বালানি সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ইউরোপকে অন্ধকারের মধ্যে রাখতে চাইবে।
এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবাহের সবচেয়ে বড় পাইপলাইনটি বন্ধ রেখেছে রাশিয়া। ক্রেমলিন যে এ পাইপলাইন ফের চালু করবে, তারও তেমন সম্ভাবনা নেই। এখন পর্যন্ত অন্য যেসব পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করছে, সেগুলোও যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে পারে।
এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার হাইড্রোকার্বনের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পদক্ষেপগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। অন্যথায় ইউরোপের জন্য রাশিয়া ও এর মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে জ্বালানি কেনার বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
এসএএইচ/কেএএ