শি জিনপিংয়ের জন্য কঠিন বছর ২০২৩?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৩৭ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

বিজয়ের মুহুর্তেও, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্বীকার করেন, চীনের ওপর কালো মেঘের ঘটা। ২০২২ সালের অক্টোবরে সমাজতান্ত্রিক চীনের একমাত্র রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার (সিপিসি) পঞ্চবার্ষিকী, ২০তম কংগ্রেসে শি জিনপিংয়ের তৃতীয় মেয়াদে দলীয় প্রধানের পদ নিশ্চিত হয় । বেইজিংয়ে প্রায় ২৩ হাজার দলীয় প্রতিনিধির সামনে বক্তৃতা দেন, দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বর্ণনায় বর্তমানের ‘কাণ্ডারী’ শি জিনপিং। শি জিনপিং, গত কয়েক দশকের মধ্যে চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা। কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও জেদংয়ের পর কেউই আর তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হননি, যেটি তিনি হলেন। কংগ্রেসে এক দশক ধরে তার মসৃণ যাত্রাপথ তুলে ধরেন শি জিনপিং। 

শি জিনপিং বলেন, দেশটির চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ‘শূন্য-কোভিড নীতি’ চীনের মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। দলটি কার্যকরভাবে ‘জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদী, ধর্মীয় চরমপন্থিসহ অন্যান্যদের একীভূত করেছে।’ যদিও এসব আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করেন তিনি। শি জিনপিং দলের নেতাদের ‘কঠিন বিপদ ও বিপজ্জনক ঝড় মোকাবিলা করার প্রস্তুত থাকার ব্যাপারেও সতর্ক করেন।

শি জিনপিং ধারণা করেন, আমেরিকার নেতৃত্বে বিদেশি শক্তি চীনকে আটকাতে চায়। এমনকি কোনো কারণ ছাড়াই। পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকেই চীনের উত্থানকে উদ্বেগজনক বলে মনে করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে চীনা প্রযুক্তি শিল্পকে বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করছে।

শি জিনপিং, বিশ্বব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্নির্মাণ করতে চান যা ‘স্বৈরাচারীদের’ খুশি করবে। তিনি চীনের কর্তৃত্ববাদী মডেলকে পশ্চিমের একটি যুক্তিযুক্ত বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ইতিহাসের যেকোনো একনায়কের চেয়ে শি জিনপিংয়ের হাতে অনেক বেশি সম্পদ রয়েছে এখন। তবুও চীন অন্যথায়, হতে পারে তার চেয়ে দুর্বল। ফলে শি জিনপিং নিজের সিদ্ধান্তের জন্য ধন্যবাদ পোষণ করেন।

শি জিনপিংয়ের দেশের অভ্যন্তরীণ জটিলতা বাড়ছে। ফলে ২০২৩ সালে ‘কান্ডারীর’ জাহাজ পরিচালনা করা কঠিন হবে।

শি জিনপিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করা। শি জিনপিং তার শূন্য-কোভিড নীতির মাধ্যমে চীনকে ঘরোয়া পরিবেশে চিত্রায়িত করেন, যা স্থানীয় লকডাউন ও প্রাদুর্ভাব রোধে কঠোর বিধিনিষেধের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। তবে তিনি ঠিকই বলেছেন, এটি অনেকের জীবন বাঁচিয়েছে।

কিন্তু এখন এই করোনা বিধিনিষেধ অর্থনীতির শ্বাসরোধ করছে। যারা কোয়ারেন্টাইনের ক্রমাগত হুমকির মধ্যে বসবাস করছেন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

সম্প্রতি বিক্ষোভের জেরে চীনে বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যদিও দেশটির অনেকেই এখনও করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য নিজস্ব উৎপাদিত একটি ভ্যাকসিনের যথেষ্ট ডোজও পায়নি সাধারণ মানুষদের অনেকেই। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায়শই দুর্বল। এই ব্যবস্থা চীনকে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ও বিভিন্ন মডেল অনুযায়ী, শূন্য-কোভিড নীতি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়বে এবং কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে দেশটিতে।

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও ২০২২ সালে প্রত্যাশার তুলনায় কম ছিল এবং যদি শি জিনপিংয়ের সরকার তার বর্তমান ট্র্যাকে চলতে থাকে তবে ২০২৩ সালে আবারও কম হবে।

দেশটির তরুণরা চাকরি খুঁজছে, বিশেষ করে স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থীরা। আবাসন ব্যবসার বাজার, যা জিডিপির একটি বড় অংশের ভিত্তি তৈরি করে তাতেও সংকট রয়েছে। তা ছাড়া, লকডাউন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, যেগুলো সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে দেয় এবং সাধারণ মানুষের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে ফেলে, সমস্যার কেবল একটি অংশ মাত্র।

শি জিনপিং আরও সমাজতান্ত্রিক, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির স্কেচ করেছেন। তিনি ধারণা করেন কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা হয় সে সম্পর্কে দলের আরও বেশি সম্পৃক্ততা জরুরি। তিনি প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং বিশ্ব থেকে চীনকে বিচ্ছিন্ন করে উদ্ভাবনের গতিকে মন্থর করেছেন এবং ব্যক্তিগত-খাতের গতিশীলতাকেও ম্লান করেছেন।

জনসংখ্যাও চীনের প্রতি বৈরী মনোভাব প্রকাশ করছে। ১৯৮০-র দশকে দলের নেতারা এক সন্তান নীতি গ্রহণ করেছিল। কেননা তখন দেশটির জনসংখ্যা খুব দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এখন দেশটির নেতারা উল্টো ভয় পান। ২০২৩ সালে চীনের জনসংখ্যা, বর্তমানে প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি। এই জনসংখ্যা আরও সঙ্কুচিত হতে শুরু করবে এবং ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে যাবে।

কয়েক বছর ধরে চীনে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে কর্মশক্তি কমছে। এটিও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করছে এবং তরুণদের উপর একটি বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে নতুন করে ২০১৫ সালে চীন দ্বি-সন্তান নীতির প্রবর্তন করে। ২০২১ সালে এটি তিন সন্তান নেওয়ারও অনুমতি দেয়। কিন্তু তরুণরা বড় পরিবার চায় বলে মনে হচ্ছে না। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় নারীপ্রতি জন্মহারের গড় সংখ্যা অনেক কম সেখানে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই সমস্যাগুলোকে পাশে রেখে চীনের ভারি ঋণের বোঝাকে দেখেন এবং যুক্তি দেন এটি তার ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছে। শি জিনপিং, যাকে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আইনসভার বার্ষিক অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট হিসাবে পুনরায় নির্বাচিত করা হবে। 

শি জিনপিং পথ পরিবর্তন করতে ইচ্ছুকও নন। এর মানে কি হতে পারে? ধীরগতিতে বর্ধনশীল চীনের কাছে পশ্চিমাদের চ্যালেঞ্জ করার জন্য কম সম্পদ থাকবে। তবে চীন, আমেরিকার দ্বারা অর্থনৈতিক শ্বাসরোধের ভয়ে, আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যদি এটি প্রত্যাশা করে এবং যদিও এখন বিশ্বকে নতুন ধারণা দিতে চায় তাইওয়ানকে দখল করে। কিছু পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন, চীন শিগগির সেই কাজ করতে পারে।

পশ্চিমাদের অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে। অভন্তরীণভাবে দুর্বল হলেও দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে থাকবে। এটি অর্ধপরিবাহী বা অস্ত্র উৎপাদনের মতো কৌশলগত কারণে বিশাল সম্পদ একত্রিত করতে পারে। অন্যান্য দেশ, এমনকি আমেরিকাও আগামীতে তাদের নিজস্ব জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। তবে বোঝা যাচ্ছে, চীনের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি অনিবার্য নয়, তবে এর পতনও অনবিার্য নয়।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এসএনআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।