প্রধান বিচারপতির বাণী নিয়ে আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া


প্রকাশিত: ০৮:০৩ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা ‘সংবিধান পরিপন্থি’ বলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে আইনজীবীদের পক্ষ থেকে  প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার বক্তব্যে সমর্থন করেন। তারা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় ‘অবৈধ’ ছিল।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব বলেন, “আজকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে যে সঙ্কট, অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক হানাহানি চলছে তার একমাত্র কারণ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন। আর এই বাতিলের পেছনে রয়েছে সংবিধান পরিপন্থি অবৈধ ওই রায়।”

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, কোনো কোনো বিচারক রায় না লিখে ঝুলিয়ে রাখছেন। তাদের উদ্দেশ্যেই প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেছেন বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, যখন একজন বিচারক রায় ঘোষণা করেন তখন তিনি শপথের আওতায় থাকেন। অবসরের পরে তো কোনো বিচারক রায় ঘোষণা করেন না, তখন তিনি রায় লেখেন।

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণা করেছিলেন। ফলে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার যা বলছে (তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল) তা প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে লুফে নিয়ে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে।

বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখার দীর্ঘদিনের এই চর্চায় কোনো সমস্যা-ই দেখছেন না সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। দায়িত্ব পালনের এক বছর পূর্ণ হওয়ায় প্রধান বিচারপতির দেয়া বাণীর প্রতিক্রিয়াই আইনজীবীদের বিভিন্ন ধরনের মতামত পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, দায়িত্ব পালনের সময় ঘোষিত রায় অবসরে যাওয়ার পর লেখার ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা দেখছি না।

রায় লিখতে কোনো কোনো সহকর্মী বিচারপতির দেরি হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করে বিচারিক এই দায়িত্ব কর্মজীবনেই শেষ করার জন্য বাণীতে তাদের প্রতি আহ্বান জানান সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

তিনি বলেন, “কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসরে যাওয়ার দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থি।”

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, যখন বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন, তখন তিনি বিচারক হিসেবে শপথে ছিলেন। ঘোষিত তারিখের দিন হিসেবেই রায়ে সই করা হয়। এই চর্চা দীর্ঘদিনের। অবসরের পরে রায় লেখা যদি অসাংবিধানিক হয়, তাহলে মাসদার হোসেন মামলাসহ অনেক মামলাই হয়তো টিকবে না। কারণ মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিচারপতি মোস্তফা কামাল অবসরে যাওয়ার পরে লিখেছিলেন। আর এ চর্চা ভারতে, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে এমনকি ইংল্যান্ডে আছে।

অবসরে যাওয়ার পরে রায় লেখা বে-আইনি এমনটি উল্লেখ করে বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, “কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না।”

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে জোর সমর্থন জানিয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিলের  রায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা।

খন্দকার মাহবুব বলেন, “অবসরের পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি- সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তরফ থেকে আমরা বারবার এই বিষয় বলেছিলাম। এখন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে এটি আরও স্পষ্ট হয়েছে।”

তিনি বলেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের পরিপন্থি বলে যে রায়টি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি সই করেন অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর।

তবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম আরও বলেছেন, বিচারক যখন বিচারক হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন, তখন যদি তিনি রায়টা ঘোষণা করেন, পরে সে রায় লিখতে কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বিচারক কিন্তু মামলার ফলাফল আগেই বলে দিয়েছেন, যা পরে লেখা হচ্ছে মাত্র।

অবসর নেয়ার পর বিচারক হিসেবে শপথ থাকে না বলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দ আমিরুল বলেন, “উনি বলছেন বিচারক যখন শপথ নেন, অবসরের গেলে আর শপথ থাকে না।”

বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল বলেন, “আমি ১২ জানুয়ারি ২০০৭ সালে অবসরে গেছি। আমি ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমার যে অসমাপ্ত লেখা রায়গুলো লিখেছি, রায়গুলো কিন্তু আমি মুক্ত আদালতে ঘোষণা করে দিয়েছি বিচারক থাকাকালে। এটা কিন্তু এই উপমহাদেশের সব জায়গায় বহুদিন যাবৎ চলে আসছে। বাংলাদেশ হওয়ার পরে, বাংলাদেশ হওয়ার আগে, পাকিস্তান আমলেও এই পদ্ধতি চলে আসছে।”

প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে আইনি কোনো জটিলতা দেখা দেবে বলে মনে করেন কি না- জানতে চাইলে বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল বলেন, এই বাণীটি বিচারিক কোনো ঘোষণার অংশ নয়। “তবে আমরা ধরে নিতে পারি এ রকম কোনো একটা সমস্যা যদি আদালতের সামনে আসে, হয়তো তিনি এই মতটাই পোষণ করবেন। এটা নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে কি হবে না, সেটা নির্ভর করবে পরবর্তী পর্যায়ে এমন কোনো মামলা আসে কি না আদালতে, তার উপর।”

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় ‘অবৈধ’ বলে বিএনপি সমর্থকদের বক্তব্যের বিষয়ে সৈয়দ আমিরুল বলেন, “আমি যতটুকু জানি, যেমন ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় কিন্তু শুনানির পর তাৎক্ষণিকভাবে শর্ট অর্ডারটা আদালত বলে দিয়েছিল। পরে পূর্ণাঙ্গ রায়টা প্রকাশ করেছেন।

সুুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এ বিষয়ে বলেন, অবসপ্রাপ্ত বিচারপতিদের রায়ে স্বাক্ষর করতে না দিতে প্রধান বিচারপতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে সংবিধানের ১৫তম, ১৩তম, পঞ্চম, সপ্তম সংশোধনীর মামলার রায়, জেল হত্যা মামলার রায়, মাসদার হোসেন মামলার রায়সহ অনেক সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

তিনি বলেন, কারণ এসকল মামলার রায় বিচারপতিরা অবসরে যাওয়ার পরে লিখেছেন। ফলে প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের কারণে এসব রায় প্রশ্নবিদ্ধ হলে দেশে চরম সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে।

এফএইচ/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।