আর্জেন্টিনায় সয়াবিনের ফলন ‘সন্তোষজনক’, আশা জাগাচ্ছে সূর্যমুখীও
বাংলাদেশ সয়াবিন তেল আমদানি করে মূলত লাতিন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মতো আমেরিকার দেশগুলো থেকে। এ বছর খরার কারণে ওই অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছিল। তার মধ্যেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসবের প্রভাবে রীতিমতো বেসামাল হয়ে পড়ে ভোজ্যতেলের বাজার, দামে তৈরি হয় সর্বকালের রেকর্ড। সেই থেকে রান্নার তেলের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে। এমন অস্থিরতার মধ্যে অবশেষে আশার বাণী শোনালো আর্জেন্টিনা।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে গত কয়েক মাস বিরূপ আবহাওয়া সত্ত্বেও সয়াবিন, সূর্যমুখী, ভুট্টার মতো তেল-জাতীয় ফসলের ফলন অনেকটাই ‘সন্তোষজনক’। বিশ্বের অন্যতম ভোজ্যতেল সরবরাহকারী রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলার সুযোগে নিজেদের রপ্তানি বাড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে আর্জেন্টাইনরা।
সম্প্রতি বুয়েন্স আয়ার্স টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর সয়াবিনসহ অন্যান্য ফসলের শক্তিশালী উৎপাদন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী শস্যঘাটতি আর্জেন্টিনার জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে।
চলতি মে মাসে আর্জেন্টিনায় ফসল কাটার ধুম পড়েছে। দেশটির রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্স থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে লোবোস এলাকার চাষিরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করছেন। শরতের বৃষ্টি আসার আগেই সয়াবিন ঘরে তুলতে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন তারা।
কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রেতা ও লোবোসের রুরাল সোসাইটির সভাপতি মার্টিন সেমিনো বলেন, সয়াবিনের উৎপাদন যেমন ভালো, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে দামও চড়া। এ কারণে উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।
আর্জেন্টিনা প্রক্রিয়াজাত সয়াবিন রপ্তানিতে বিশ্বে এক নম্বর এবং ভুট্টা রপ্তানিতে দ্বিতীয়। দেশটির লোবোস এলাকায় দুটি ফসলই বেশ ভালো জন্মে।
১৯৯০-এর দশকে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের পর থেকে আর্জেন্টিনার অন্যতম প্রধান কৃষিপণ্য হয়ে উঠেছে তেলবীজ। গত চার দশকে তাদের জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ। কৃষির ওপর ভর করেই ২০০১ সালে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠেছিল দেশটি।
খবরে বলা হয়েছে, এ বছর আর্জেন্টিনায় প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখ হেক্টরে লাগানো হয়েছে সয়াবিন। বাজে আবহাওয়ার কারণে এ বছর তাদের কৃষি উৎপাদন ১২ কোটি ৭০ লাখ টন দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা গত বছরের চেয়ে দুই শতাংশ কম। তবে উৎপাদন কমলেও বাড়তি মূল্যের কারণে সেই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
আর্জেন্টিনার চাষিরা এরই মধ্যে গম ও সূর্যমুখীর চাষ করেছেন, দুটোরই ফলন হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। তারা এখন চাষ করছেন সয়াবিন ও ভুট্টা। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে গম বপনের নতুন মৌসুম শুরু হবে দেশটিতে।
ধারণা করা হচ্ছে, আর্জেন্টিনার কৃষিপণ্য রপ্তানি এ বছর রেকর্ড ৪ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বেশি।
আর্জেন্টিনা তার চাহিদার ৬০ শতাংশ রাসায়নিক সার বিদেশ থেকে আমদানি করে, যার ১৫ শতাংশ কেনে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধ ও এর প্রভাবে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী সার সরবরাহেও সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সয়াবিন চাষে সারের প্রয়োজন হয় খুবই কম।
সূর্যমুখীতে বাম্পার ফলন?
বর্তমান জটিল বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর্জেন্টিনার সামনে সূর্যমুখী তেলের বাজার ধরার দারুণ সুযোগ তৈরি করেছে। সয়াবিনের মতো এতেও সার কম লাগে, তার ওপর সূর্যমুখী তেলের রপ্তানি শুল্কও অনেক কম। আর্জেন্টিনায় সয়াবিন তেলে যেখানে ৩৩ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক দিতে হয়, সেখানে সূর্যমুখী তেলে লাগে মাত্র সাত শতাংশ।
রেকর্ড উৎপাদনের (৩৪ লাখ টন) পর এ বছর দেশটিতে সূর্যমুখী চাষ করা জমির পরিমাণ দুই কোটি হেক্টরে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা আগেরবারের তুলনায় অন্তত ১৭ শতাংশ বেশি।
রোজারিও গ্রেন এক্সচেঞ্জের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক টমাস রদ্রিগেজ জুরো বলেন, দাম রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি থাকায় আর্জেন্টিনাকে অবশ্যই এর সুযোগ নিতে হবে। তারমতে, মূল্যবৃদ্ধি অস্থায়ী, যুদ্ধ শেষ হলে এটিও শেষ হয়ে যাবে। তবে আর্জেন্টিনায় এর প্রভাব হবে আরও সুদূরপ্রসারী।
টমাস বলেন, সার ঘাটতির কারণে ফলন কমায় গম চাষের জমি কমে যাবে এবং চাষিরা সয়াবিন চাষে উৎসাহিত হবেন।
ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর আর্জেন্টিনায় সয়াবিন উৎপাদন কিছুটা কমে ৪ কোটি ১০ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। তবে রপ্তানি আয়ের দিক থেকে নতুন রেকর্ড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। টমাসের পূর্বাভাস অনুসারে, আর্জেন্টিনা এ বছর ২ হাজার ৩৭০ কোটি ডলারের সয়াবিন রপ্তানি করতে পারে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭০ কোটি ডলার বেশি।
কেএএ/এএসএম