সাবরিনার অভিজ্ঞতায় পাকিস্তান
বাংলাদেশের রাজনীতি ও জীবনধারা, রাজনীতি থেকে ধর্ম পর্যন্ত সর্বত্রই পাকিস্তান প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়ে আসছে। বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান প্রসঙ্গ পাকিস্তান। পাকিস্তানের পক্ষে বিপক্ষে রাজনীতির চক্র ঘুরে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে ইসলামী রিপাবলিক বানানোর চেষ্টা, জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটানো, ধর্মান্ধতা রপ্তানি করা বা আইএসআই-এর সহায়তায় পুরো দেশটাকে অস্থির করার ব্যাপারতো আছেই, দেশে কিছু রাজনীতিক আছে যারা পাকিস্তানি দালালও। এই দালালদের রাজনৈতিক প্লাটফরম আছে। আছে জোট। এজন্য এদের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে। এজন্যই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কথা বলা মানেই এখন কার্যত পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়াই করা। সেই যে ৪৮ সাল থেকে এই লড়াই শুরু হয়েছে, বায়ান্নো, ঊনসত্তুরের আন্দোলন বা একাত্তরের যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত করেও তার সমাপ্তি আমরা ঘটাতে পারিনি । এ যেন এক রাক্ষসের গল্প যার কোনো বিনাশ নেই। রাজপুত্তুর রাক্ষসকে মেরে ফেলে-কিন্তু সেই রাক্ষস আবার জীবিত হয়ে ওঠে। যেখানেইে রাক্ষসের রক্তের ফোটা পড়ে সেখান থেকেই জন্ম নেয় পাকিস্তানি রাক্ষস।
পাকিস্তান কেবল যে জাতিগতভাবে আমাদের নিপীড়ক তাই নয়, এখনও একাত্তরে তারা এই দেশটির ওপর যে নির্যাতন ও গণহত্যা চলিয়েছিলো তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি। পাকিস্তানের দালাল গোলাম আজম বা অন্য যুদ্ধাপরাধীরা ফাঁসির কাষ্ঠে লটকেও একাত্তরের ভুলের কথা স্বীকার করেনা। বরং বাংলাদেশে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ফাঁসি দিই আর চোখের পানি ফেলে পাকিস্তানিরা। এমনকি গোলাম আজমের গায়েবানা জানাযা হয় পাকিসস্তানে এবং পাকিস্তানের সরকারি নেতারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে। তবে ওখানেও কিছু কিছু লোক হয়তো ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে দুঃখবোধ করে থাকেন। পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীরের মতো লোকেরা আছেন যারা পাকিস্তানের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। আবার তারাই বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কষ্ট পান।
সাধারণভাবে পাকিস্তানিরা পশ্চাদপদ মানসিকতার অধিকারী। তারা অনেকাংশেই ধর্মান্ধ ও গোড়া। মৌলবাদের ধারক ও জঙ্গীবাদের উৎস হিসেবে দেশটির কুখ্যাতি আছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীর বিচারও পাকিস্তানকে সম্পৃক্ত করে। কি অদ্ভুত কাণ্ড! সম্প্রতি পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে আরও বাড়াবাড়ি করেছে। এর বাইরেও তারা বাংলাদেশে তাদের হাই কমিশনের মাধ্যমে জঙ্গীদের মদদ দেয়ায় বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি কূটনীতিককে বহিষ্কার করতে হয়েছে। এর বিপরীতে পাকিস্তান বাংলাদেশি এক নারী কূটনীতিককেও প্রত্যাহার করতে নির্দেশ প্রদান করে।
অনেকেরই এমন ধারণা হতে পারে যে বিষযটি কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই রয়েছে এবং পাকিস্তানিরা ব্যক্তিগতভাবে অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু আমাদের সামনে যেসব দৃষ্টান্ত প্রকাশিত হয় তাতে বোঝা যায় যে পাকিস্তানিরা বদলায়নি-হয়তো বদলাবে না। সম্প্রতি অধ্যাপিকা মাহফুজা বেগম একটি টিভির টকশোতে জানান যে, সৌদী আরবে হজ্ব করতে যাওয়া এক বাংলাদেশি নিজের পরিচয় দেবার পরও তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক পাকিস্তানি তাকে “পূর্ব পাকিস্তানি” দাবি করে। বোঝা যায় যে এটি তাদের নোংরা মানসিকতার প্রকাশ।
এমন অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে অহরহ পাচ্ছি। মাঝে মধ্যে পাকিস্তানের নাগরিকদের আচার আচরণ আমাদের ব্যক্তিজীবনকেও সম্পর্কযুক্ত করে। ভেতরে আমরা পাকিস্তানি নাগরিকদেরকে সরাসরি মোকাবেলা করি না কিন্তু আমাদের যেসব নাগরিক প্রবাসে থাকেন তারা পাকিস্তানি প্রবাসীদের সংস্পর্শে এলে কী রকম পরিস্থিতি তৈরি হয় সেইসব আমরা হর-হামেশাই শুনে থাকি। আমার কাছে পাকিস্তানি-বাঙালি মতান্তরের অসংখ্য ঘটনার বিবরণ আছে যাতে বিশেষ করে পাকিস্তানের কিছু কিছু মানুষের আচার আচরণ অদ্ভুত ও কিম্ভুত কিমাকার মনে হয়েছে। ওদের অনেকেই মনে করে যে, বাংলাদেশটা এখনও পাকিস্তানেরই অংশ। ওরা আমাদেরকে ছোট করে দেখার চেষ্টা করে। এমনকি বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে ওরা মুসলমান বলে গণ্য করেনা। একাত্তরেও ওরা আমাদেরকে হত্যা করেছে-আমরা মুসলমান নই বলে। আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত নিয়েছে এই বলে যে ওরা বিধর্মী। অন্যদিকে ওদের ধর্মান্ধতা, গোড়ামী বা কুসংস্কার ওরা আমাদের ওপরও চাপাতে চায়।
একটি সত্য ঘটনা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে পাকিস্তানিদের সাধারণ মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরতে চাই। আমার বড় মেয়ে সাবরিনা শারমিন পেশায় ডাক্তার। অভিজ্ঞতাটি ওর। সে এমএসএফ নামক একটি আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করে। এনজিওটির কাজের ক্ষেত্র স্বাস্থ্যসেবা। দুনিয়া জোড়াই তাদের কাজ। বাংলাদেশেও রয়েছে তাদের মিশন। তবে আমার মেয়ের কাজের শুরু আফগানিস্তান থেকে। ওখানকার মা ও শিশুদের সেবা করতে গিয়েই সে এমএসএফ-এর সাথে প্রথম পরিচিত হয়। সেখানে থাকতেই তার কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হতে থাকে। তার নতুন অভিজ্ঞতা হতে থাকে যে, দুনিয়ার সকল জায়গায় মুসলমানিত্ব বাংলাদেশের মতো নয়। তার আচার আচরণও কাপড় চোপড়ে পরিবর্তন আনতে হয়। আফগানিস্তানে বোরখা না পরলেও মাথায় ওড়না পেচাতে হতো। সেবারই প্রথম আমার মেয়ে নারীদের পশ্চাদপদতা কাকে বলে তা স্বচক্ষে দেখে। আফগান মেয়েরা নিজেরাই যে তাদের সম্পর্কে ধারণা রাখেনা সেটি সে বুঝতে পারে। তখনই তার নিজের দেশকে নিয়ে গর্ব করার মতো একটি দৃশ্যমান অবস্থা তৈরি হয়। এখনকার অবস্থা তাকে আরও গৌরবান্বিত করে। যখন সে দেখে যে তার নিজের দেশের ৫৩ ভাগ শিক্ষার্থী মেয়ে তখন তার করুণা হয় আফগান মেয়েদের জন্য। পাকিস্তানের মালালাদের লড়াই যে তার নিজের রাষ্ট্র ও সমাজের চরম পশ্চাদপদতারই প্রকাশ সেটিও সে এখন ভালোই বোঝে। ঘটনাচক্রে সেই পাকিস্তানিদের নিয়ে তার অভিজ্ঞতা সত্যি দুঃখজনক।
পাকিস্তানকে নিয়ে সে প্রথম সমস্যায় পড়ে আফগানিস্তানে গিয়েই। কাবুল থেকে সে সচরাচর দিল্লী হয়ে দেশে ফিরতো। একবার তার মনে হলো সড়কপথে খাইবার পাস হয়ে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে করাচি এসে সেখান থেকে আকাশ পথে ঢাকা আসবে। খাইবার পাস হয়ে চলার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাটি সে পেতে চেয়েছিলো। জীপে করে সে পাকিস্তানে পৌঁছেছিলো। বিপত্তি হল তখন যখন সে খাইবার পাস দিয়ে পেশোয়ার পৌঁছায়। ওখানে এসেই সে পড়ে গেলো গোলাগুলিতে। কোনো মতে জানে বেঁচে সেবার সে ঢাকা এসেছিলো। এরপর সে এমএসএফকে জানিয়েছে, দুনিয়ার যে কোন দেশে ওকে ওরা পাঠাতে পারে কেবল পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া। পাকিস্তানের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা সে বলেছে। আফগানিস্তানের বিপদটা তালেবানদের চাইতেও বেশি তার হিটিংবিহীন শীতকালে। তবে ওর ধারণা আফগানিস্তানের চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর পাকিস্তান। একবারের অভিজ্ঞতাই তাকে সারা জীবনের জন্য পাকিস্তানবিমুখ করে দিয়েছে।
দ্বিতীয়বার সে বিপদে পড়ে পাকিস্তান নয়, পাকিস্তানিকে নিয়ে। তখন সে ওজবেকিস্তানে। প্রজেক্ট সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পেয়েছে সেবার। ছোটখাটো দেখতে বলে সবারই ধারনা ছিলো ওর বয়স অনুপাতে দায়িত্বটা বেশি বড় হয়ে গেছে। তবে সবাই ওকে মেনেই কাজ করছিলো। বিপত্তি বাধালো পাকিস্তানের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক জাভেদ সাহেব। তিনি কোনোভাবেই সাবরিনাকে পিসি (প্রকল্প সমন্বয়কারী) হিসেবে মানতে রাজি না। প্রথমত তিনি মনে করতেন সাবরিনার বয়স কম-ওর পিসি হবার মতো যোগ্যতা নেই। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি ভয়াবহ। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশের একটি মেয়ে পিসি হতে পারে না। বাংলাদেশ তার এলার্জি। মেয়েতেও তার এলার্জি। কয়েক সপ্তাহ ধরে জাভেদ সাহেব এমএসএফ কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে চাইলেন যে, মেয়েদেরকে এ ধরনের নেতৃত্বের কাজ দেয়া যায় না। যদি দিতেই হয় তবে ইউরাপ বা আমেরিকার কোনো মেয়েকে দেয়া হোক, বাংলাদেশের নয়। কিন্তু এমএসএফ তার কথা শুনলো না। সাবরিনাকেই প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে রাখা হলো। এমএসএফ-এর কর্মকর্তারা ইউরোপীয় বিধায় পাকিস্তানি জাভেদের প্রচণ্ডবিরোধিতার মুখেও সে টিকে গেল।
এর পরের ঘটনাটি আরও ভয়াবহ। এক সময়ে এমএসএফ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই অনুষ্ঠানে তাদের কর্মীদের নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত গাইবার ব্যবস্থা করা হয়। সবাই তাদের জাতীয় সঙ্গীত গায়। সাবরিনাও গায়। বর্ণানুক্রমিক বলে তার পালা এলো সবার আগে। যখন পাকিস্তানের পালা এলো তখন জাভেদ সাহেব সাবরিনাকে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বললো। সাবরিনা বললো, দুনিয়ার সকল দেশের জাতীয় সঙ্গীতের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা আছে। আপনি যখন পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইবেন তখনও আমি দাঁড়াব। যদিও আমি লক্ষ করেছি যে, যখন আমি আমার জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছি তখন আপনি দাঁড়াননি-ওটা আপনার হীনমন্যতা। কিন্তু আমি আপনার জাতীয় সঙ্গীতকে সম্মান করি। আমি দাঁড়াচ্ছি। কিন্তু আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নেয়া মানুষ হিসেবে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে জানি না। জানার ইচ্ছাও নাই। জাভেদ সাহেব এরপর হৈচৈ লাগিয়ে দিলেন এবং এমএসএফ-এর পদস্থ কর্মকর্তাদের এসে তাকে শান্ত করতে হয়েছে। তিনি যেসব কথা বলেছেন তা আমরা বস্তুত বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকদের মুখে শুনি। পাকিস্তান ভাঙার পেছনে ভারতের হাত থাকা থেকে শুরু করে বাঙালিরা যে মুসলমান নয় সেটি তিনি বললেন।
এরপর জাভেদ সাহেবের স্ত্রী এসেছিলেন উজবেকিস্তানে। মজার কাণ্ড হলো তার স্ত্রীর সাথে কোনো পুরুষ মানুষ কথা বলতে পারেনি বা দেখাও করতে পারেনি। তার মতে কোনো অমুসলমান মহিলাও তার সাথে দেখা করতে পারবে না। এমনকি সাবরিনাকেও তিনি তার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে দেননি।
সেদিন যখন মেয়ের সাথে একাত্তরের মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিলাম তখন মেয়ে বলেছিলো, বাবা তোমার জীবনের সবচেয়ে সেরা কাজটি বোধহয় এটি যে, তোমরা পাকিস্তান থেকে আমাদের জন্মভূমিটাকে আলাদা করতে পেরেছিলে। নইলে কিভাবে যে ওদের সাথে এক দেশের নাগরিকের পরিচয় দিতাম সেটাই ভাবতে পারি না। আমাকে যদি কেউ পাকিস্তানি বলতো তবে মনে হতো একটা চরম গালি দিলো কেউ। আমার মেয়ের উপলব্ধিটা পুরো দেশের সকল সন্তানের হোক সেই কামনা করি।
লেখাটি শেষ করার আগে, জন্মের পর থেকে একাত্তর, তার পর এবং সাম্প্রতিককালে পাকিস্তান সরকার ও সেই দেশের জনগণ বাংলাদেশের সাথে যে ধরনের আচরণ করে যাচ্ছে তাতে এই জঘন্য দেশটির সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক বহাল রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ আছে কিনা সেই প্রশ্নটি রেখে যেতে চাই।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক ।
এইচআর/এমএস