অর্থনীতি-রাজনীতি-করোনা: সংকটে বাংলাদেশের প্রতিবেশীরা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে যখন টানটান উত্তেজনা, ঠিক তখন হঠাৎ করেই বিশ্বরাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে এশিয়া; আরও নির্দিষ্ট করে বললে দক্ষিণ এশিয়া। পাকিস্তানে চলছে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে জটিল রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট। তাতে পূর্বসূরিদের মতো ইমরান খানও পাঁচ বছর পূরণ হওয়ার আগেই ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। শ্রীলঙ্কার সংকট অর্থ দিয়ে শুরু হলেও এখন তাতে রাজনীতি জড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমার-আফগানিস্তানে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করা অগণতান্ত্রিক সরকার আরও শক্তভাবে গদি আঁকড়ে ধরেছে। চীনে হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। স্বস্তিতে নেই বড় প্রতিবেশী ভারতও।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোতে কোথায় কী ধরনের সংকট চলছে-
পাকিস্তান
ইসলামাবাদে রাজনৈতিক টানাপোড়েন নতুন কিছু নয়। পাকিস্তানের কোনো শাসকই আজ পর্যন্ত পাঁচ বছর ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। একই পরিণতি হতে চলেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানেরও।
বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর দ্বন্দ্ব এখন সুস্পষ্ট। বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার অভিযোগ তুলে পদত্যাগ দাবি করেছেন। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ইমরানের কিছু জোটসঙ্গীও। এরই মধ্যে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে সরকারবিরোধীরা। এ অবস্থায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে গত রোববার (৩ এপ্রিল) অনাস্থা ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই ভোট ‘অসাংবিধানিক’ দাবি করে তা বাতিল করে দেন প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহচর ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি।
এরপর ইমরানের পরামর্শে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। এর মাধ্যমে আপাতত অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আটকাতে পেরেছেন ইমরান খান। কিন্তু দেশকে ঠেলে দিয়েছেন বড় সাংবিধানিক সংকটের মুখে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শেষপর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু পরপর তিনদিন শুনানি করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি সর্বোচ্চ আদালত। সবশেষ বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কাসিম সুরির রুল অবৈধ ঘোষণা হলে পার্লামেন্ট পুনর্বহাল করে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে হবে ইমরান খানকে, যেখানে তার হেরে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আর তা না হলে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকার সুযোগ পাবেন পিটিআই প্রধান।
পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক সংকটে আবার নতুন রঙ লাগিয়েছেন ইমরান খান। তার দাবি, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে রাশিয়া। মস্কোও বলছে, ‘অবাধ্য’ ইমরানকে সরাতে নির্লজ্জভাবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। অর্থাৎ, পাকিস্তানের সংকট শুধু জাতীয় পর্যায়ে নেই, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক তরজাও শুরু হয়ে গেছে।
শ্রীলঙ্কা
পাকিস্তানে যখন রাজনৈতিক সংকট চলছে, তখন অর্থনৈতিক দুর্দশায় বিপর্যস্ত দক্ষিণ এশীয় আরেক প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে এখন শুধুই হাহাকার। খাবারের দাম আকাশচুম্বী। চলছে জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট। তেল সংগ্রহের জন্য হাজার-হাজার মানুষ লাইনে ভিড় করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পেট্রল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে লঙ্কান সরকার।
কাগজের অভাবে স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে শ্রীলঙ্কা। কারণ, কাগজ আমদানির মতো বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে নেই। বিদেশি ঋণের ভারে আজ জর্জরিত দ্বীপরাষ্ট্রটি। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয়ও মেটাতে পারছে না। যার ফলে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। চালের দাম দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ২২০ রুপি। বিদ্যুৎ না থাকায় কেরোসিনের বাতি, কাঠ কয়লার ইস্ত্রি মেশিনে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন লঙ্কানরা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আর কখনো এতটা দুরবস্থায় পড়েনি দেশটি।
চরম অর্থসংকটের মুখে ক্ষুব্ধ জনগণ লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করছে। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। পরিস্থিতি সামলাতে কারফিউ জারি করেছে লঙ্কান সরকার। চলছে ব্যাপক ধরপাকড়।
এর মধ্যেই গত ৩ এপ্রিল একযোগে পদত্যাগ করেন শ্রীলঙ্কার সব মন্ত্রী। চেয়ার ছাড়েননি শুধু প্রেসিডেন্টের ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। এরপর রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের আহ্বান জানান লঙ্কান প্রেসিডেন্ট। তবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বিরোধীরা। তারা প্রেসিডেন্টেরই পদত্যাগ দাবি করেছেন। তবে চতুর্মুখী চাপের মুখেও প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে জানিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করছেন না। ফলে আপাতদৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কার এমন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকটের আশু কোনো সমাধান আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
ভারত
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে ভারতমুখী আশ্রয়প্রার্থীর ঢল নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সেই স্রোত শুরুও হয়ে গেছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশটি নিজেই খুব একটা স্বস্তিতে নেই।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচ লেগেছে ভারতের গায়েও। দেশটিতে হু হু করে বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। গত ১৫ দিনে সেখানে ১৩ দফা তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারেও। ভারতে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দামই এখন ঊর্ধ্বমুখী।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পর রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। এতে করে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক ভারত বিপাকে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা আগেই ধারণা করেছিলেন, পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পরপরই জ্বালানির দাম বাড়াবে কেন্দ্রীয় সরকার। নির্বাচন শেষ হতে না হতেই সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
চীন
চীনের সমস্যা ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো নয়। তাদের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে করোনাভাইরাস। সম্প্রতি দেশটিতে আবারও বাড়তে শুরু করেছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ। গত কয়েকদিনে চীনের বিভিন্ন শহরে যেভাবে করোনা ছড়িয়েছে, ২০২০ সালে উহানের পর আর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি তাদের।
শুরু থেকেই ‘জিরো কোভি’ নীতি মেনে চলেও করোনার বিস্তার ঠেকাতে পারেনি চীনা কর্তৃপক্ষ। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি আবারও লকডাউনের মুখে পড়েছেন সাংহাইয়ের আড়াই কোটির বেশি মানুষ। শহরটিতে সবার করোনা পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিধিনিষেধ তোলার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ।
গত ৫ এপ্রিল সাংহাইতে ১৬ হাজার ৭৬৬ জন উপসর্গবিহীন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন, একদিন আগে যার সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৮৬ জন। এদিন উপসর্গযুক্ত নতুন করোনা রোগীর সংখ্যা ২৬৮ থেকে বেড়ে ৩১১তে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, লকডাউনের কারণে এক মাসে ৪ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বা জিডিপির ৩ দশমিক ১ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে চীনের।
মিয়ানমার
চীন-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এক বছরের বেশি হলো। সেখানে এখনো উত্তেজনা কমার নামগন্ধ নেই। দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে গণতন্ত্রপন্থিরা জান্তা সরকারকে হটাতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। চলছে বিচ্ছিন্ন সংঘাত।
মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) নামে স্থানীয় একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা বলছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তা বাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৭০০ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন ১০ হাজারের বেশি।
এএপিপির হিসাবে, মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত জান্তাবিরোধী আন্দোলনকর্মীদের প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ ঘরবাড়ি-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে সামরিক সরকার।
আফগানিস্তান
মিয়ানমারের মতো আফগানিস্তানেও অগণতান্ত্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তপোক্ত হয়েছে। দেশটিতে তালেবান আবারও তাদের নব্বইয়ের দশকের কট্টরপন্থি শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষণ দেখাচ্ছে।
তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে ষষ্ঠ শ্রেণির ওপর মেয়েদের স্কুলে যাওয়া এখনো বন্ধ। খবর এসেছে, পুরুষ আত্মীয় ছাড়া নারীদের প্লেনে ওঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উন্মুক্ত পার্কে নারী-পুরুষ একসঙ্গে প্রবেশ বন্ধ, তাদের জন্য আলাদা আলাদা দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহারও নিষিদ্ধ করেছে তালেবান প্রশাসন।
অবশ্য এর মধ্যেই আফগান সরকারের একটি সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানে আফিম চাষ নিষিদ্ধ করেছে তালেবান। বিশ্বের বৃহত্তম আফিম উৎপাদক তারা। তাছাড়া তালেবান ক্ষমতা দখলের জেরে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দসহ আফগানিস্তানে অর্থ সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। এ অবস্থায় আফিম চাষ নিষিদ্ধ করায় আফগানদের অর্থসংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিক টাইমস, জিও নিউজ, ডয়েচে ভেলে, রয়টার্স, ইরাবতি
কেএএ/এসএইচএস/এএসএম