রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে ইসরায়েলের এত মাথাব্যথা কেন?
খান আরাফাত আলী খান আরাফাত আলী , সহ -সম্পাদক , আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫৭ পিএম, ০৭ মার্চ ২০২২
রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বে মধ্যস্থতা করতে চেয়ে হঠাৎই আলোচনায় উঠে এসেছেন দখলদার ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর মধ্যস্থতার অনুরোধ নিয়ে মস্কো সফর করা একমাত্র বিদেশি নেতা তিনি। যদিও এর মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও দেখা করেছেন, তবে তাদের আলোচনার বিষয় ছিল মূলত বাণিজ্যিক। ফলে ক্ষমতায় বসার এক বছর হওয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বড় একটি ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বড় বাজিই ধরেছেন বলা যায়। কিন্তু কেন? ফিলিস্তিনিদের ওপর বছরের পর বছর ধরে অত্যাচার-আগ্রাসন চালানো ইসরায়েল হঠাৎ ‘শান্তির দূত’ হয়ে উঠতে চাইছে কেন?
বার্তা সংস্থা এপির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশ্বমঞ্চে অপরীক্ষিত বেনেট রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে নাক গলিয়ে ইসরায়েলকে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি ফেলেছেন। যুদ্ধরত দুই পক্ষকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনা তার জন্য অগ্নিপরীক্ষা হয়ে উঠতে পারে।
যুদ্ধের এক দিকে থাকা মস্কোর সঙ্গে ইরান-সিরিয়া ইস্যুতে ইসরায়েলের সম্পর্ক বেশ স্পর্শকাতর। ফলে উল্টাপাল্টা কিছু করে পুতিনকে ক্ষেপিয়ে তুললে হিতে-বিপরীত হতে পারে ইসরায়েলিদের জন্য। আবার রুশ আগ্রাসনের নিন্দা না জানালে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুরোনো মিত্রের চক্ষুশূল হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে তাদের।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে ইসরায়েলের এত মাথাব্যথার কারণ-
বেনেটের বাজি
গত বছর ভিন্ন মতাদর্শী আটটি দলের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন বেনেট। উগ্র ইহুদিবাদী এ নেতা অতীতে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করলেও পূর্বসূরীর তুলনায় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অভিজ্ঞতা ও ক্যারিজমা দুটোরই বেশ ঘাটতি রয়েছে। ফলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি ও সাবেক কেজিবি এজেন্ট পুতিনকে সমঝোতায় রাজি করাতে হলে তাকে বড় পরীক্ষাই দিতে হবে।
২৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের সমর্থনে ইসরায়েলিদের বিক্ষোভ। ছবি সংগৃহীত
ইসরায়েলে বেনেটের ক্ষমতালাভের পদ্ধতি বেআইনি উল্লেখ করে তার সরকারকে অবৈধ বলে দাবি করে আসছে বিরোধীরা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার জনসমর্থনও কমতির দিকে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর ক্ষেত্রে সংযত অবস্থান। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বারবারই ইউক্রেনের জনগণের পক্ষে তার সমর্থনের কথা বললেও সরাসরি মস্কোর নিন্দা জানাননি একবারও। এক্ষেত্রে পুরোনো মিত্র পশ্চিমাদের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পথে না গিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার পক্ষে থাকায় স্বদেশেই সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি।
পশ্চিমারা যখন একপাক্ষিকভাবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঝড় শুরু করেছে, তখন পুতিন-জেলেনস্কি উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছেন নাফতালি বেনেট। মস্কোকে আলোচনায় বসাতে তার প্রচেষ্টায় অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টেরও। ফলে এই সংঘাতে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে নিজের অবস্থান কিছুটা হলেও শক্তিশালী করেছেন বেনেট। আর এই চেষ্টা সফল হলে তার রাজনৈতিক ভাগ্য পুরোপুরি বদলে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ইউরোপ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এথার লোপাটিনের কথায়, বেনেট নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছেন। তিনি এমন এক নেতা, যিনি ভোটের সমস্যায় ছিলেন, জনগণের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি জাদুও দেখাতে পারেন।
কূটনীতির রণাঙ্গন
রাশিয়া-ইউক্রেন উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা অল্প কিছু দেশের মধ্যে ইসরায়েল অন্যতম। ইউক্রেনে দুই লাখের মতো ইহুদি রয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েক হাজার এরই মধ্যে ইসরায়েলে আশ্রয় নিয়েছেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে যেতে পারেন আরও অনেকে। যুদ্ধের আরেক পক্ষ রাশিয়াতেও কয়েক লাখ ইহুদির বসবাস।
তবে রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ মূলত কৌশলগত কারণে। সিরিয়ায় নিরাপত্তা সমন্বয়ে রাশিয়ার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে এখনো রাশিয়ার সেনা উপস্থিতি রয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিতই কথিত ‘শত্রুপক্ষের’ ওপর বিমান হামলা চালায়।
২০২১ সালের ২২ অক্টোবর রাশিয়ার সোচি শহরে বেনেট ও পুতিন। ছবি সংগৃহীত
তাছাড়া, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনাকারী শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম রাশিয়া। এ বিষয়ে তেহরানের সঙ্গে তাদের শিগগির একটি চুক্তি হওয়ার কথা। ইসরায়েল বরাবরই এই চুক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।
ফলে ইসরায়েল যদি সত্যিই রাশিয়াকে আলোচনায় বসাতে চায়, তাহলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানটা ধরে রাখতে হবে। এমনকি রাশিয়ার আগ্রাসন তীব্র হলেও তা নিয়ে কিছু বলতে পারবে না তারা।
ইসরায়েলের পদক্ষেপে সামান্য ভুল হলেই রশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হয় উঠতে পারে। আর আলোচনা ব্যর্থ হলে ধূর্ত পুতিন হয়তো যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার জন্য বেনেটকেই দায়ী করে বসতে পারেন। ফলে নায়ক হতে গিয়ে উল্টো ভিলেন হয়ে যাওয়ার ভয়ও থাকছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর জন্য।
সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু?
মস্কো সফর থেকে ফিরেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভায় বলেছেন, এতে এগিয়ে যাওয়া ইসরায়েলের ‘নৈতিক দায়িত্ব’, যদিও সাফল্যের সম্ভাবনা খুব বেশি নয়।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক কর্মকর্তা মিচলিন-শাপিরের মতে, সদিচ্ছা যতই থাক, এত জটিল সংকটে মধ্যস্থতা করার মতো সামর্থ্য এই মুহূর্তে ইসরায়েলের নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের চেয়ে বড় খেলোয়াড় ফ্রান্স-তুরস্কের চেষ্টা এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে।
ভাষ্যকার বারাক রাভিদ ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে লিখেছেন, একদিকে, বেনেট রাতারাতি বিশ্বমঞ্চে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছেন এবং ইসরায়েলের পক্ষে বেশ কিছু রাজনৈতিক পয়েন্ট জিতেছেন। কিন্তু অন্যদিকে, তিনি বিশাল একটা ঝুঁকি নিয়েছেন। শুধু রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে নিয়েই নয়, ইসরায়েল রাষ্ট্র ও বিশ্বে এর অবস্থান নিয়েও বাজি ধরেছেন বেনেট।
এ বিশ্লেষকের কথায়, কতটা গভীর না জেনেই ইউক্রেনের কাদায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী।
কেএএ/এএসএম