যুদ্ধ শুরুর জন্য যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো নিষেধাজ্ঞায় পড়ে না কেন?
ইউক্রেনে হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। ১১তম দিনেও দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। ইউক্রেন ছেড়ে পালাচ্ছে লাখ লাখ নাগরিক। এমন পরিস্থিতিতে মস্কোর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। বিশেষ করে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। অর্থ লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম সুইফট থেকে রাশিয়ার একাধিক ব্যাংককে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমারা যে ভূমিকা পালন করছে তা অন্যান্য যুদ্ধগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরুর জন্য কোনো নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি। তাই পশ্চিমাদের এমন অবস্থানকে ভণ্ডামি বা দ্বিমুখী নীতি বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম আরটির এক মন্তব্য প্রতিবেদনে ‘মিডনাইট ইন দ্য আমেরিকান এমপায়ার, হাউ করপোরেশনস অ্যান্ড দেয়ার পলিটিক্যাল সার্ভেন্টস আর ডেস্ট্রয়িং দ্য আমেরিকান ড্রিম’ বইয়ের লেখক রবার্ট ব্রিজ বলেন, ইউক্রেনে হামলাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর তীব্র বিরোধিতায় নেমেছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সংগঠিত যুদ্ধগুলোর সময় দেখা যায়নি। তাই এটিকে এক ধরনের ভণ্ডামি বলে মনে করছেন তিনি।
রবার্ট ব্রিজ বলেন, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা। সেজন্য তাদের কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি। এখন ইউক্রেনেও একই পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো। এদিকে পশ্চিমা বিশ্ব ভ্লাদিমির পুতিনের নেতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করছে। পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে ইউক্রেনে হামলার কারণে পুতিনকে জার্মানির নব্যনাৎসি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শুধু ভণ্ডামি ও দ্বৈতনীতির মানদণ্ড কোনো দেশকে শত্রুতা শুরু করার ন্যায্যতা প্রদান করে না। ২০০১ সালে ন্যাটোসহ পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী কয়েকটি যুদ্ধের পথ তৈরি করছে। কিন্তু এজন্য তাদের কোনো পরিণতি ভোগ করতে হয়নি। তার মানে এই নয় যে রাশিয়া বা অন্য কোনো দেশ এ ধরনের যুদ্ধের বৈধতা পেয়ে যাবে।
ব্রিজ বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে গত এক দশক ধরেই সতর্ক করে আসছে মস্কো। ২০০৭ সালে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের সীমান্তে সামরিক অবকাঠামো বাড়ানো কেন প্রয়োজন? কেউ কি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন?’ পরে আরেক বক্তব্যে পুতিন বলেন, রুশ সীমান্ত পর্যন্ত সামরিক অবকাঠামো সম্প্রসারণের বিষয়টি কোনো রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পছন্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তবে পুতিনের এসব সমালোচনায় কর্ণপাত না করে ন্যাটো আরও চারটি দেশ আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টিনিগ্রো ও উত্তর মেসিডোনিয়াকে জোটের সদস্য করে।
কিন্তু মস্কোর সব শেষ সতর্কতা আসে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনকে উন্নত অস্ত্র দেওয়া শুরু করে ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করার চেষ্টা চালায়। এরপরই ইউক্রেনকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করতে থাকে রাশিয়া। বারবার আপত্তি জানানো পর গত বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়ার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যায় ও পূর্বদিকে যেকোনো ধরনের সম্প্রসারণ কার্যক্রম বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটোকে দাবি জানিয়ে খসড়া পাঠায়। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয় ইউক্রেনের ভূ-খণ্ডে, পূর্ব ইউরোপে, দক্ষিণ ককেশাসে ও মধ্যে এশিয়ায় ন্যাটোর কোনো সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত নয়। তবে এক্ষেত্রে পশ্চিমা নেতারা রাশিয়ার প্রস্তাব দম্ভের সঙ্গে উপেক্ষা করে।
রবার্ট ব্রিজ আরও বলেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম এমনভাবে তথ্য দিচ্ছে যাতে মনে হয়, ২৪ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মনে হয়েছে, ‘দিনটা সুন্দর, ইউক্রেনে হামলা চালানো যাক।’ কিন্তু ঘটনাটা এমন নয়। এ কথা কেউ বলতে পারবে না মস্কো আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে নিরাপত্তা নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানায়নি। তবে এমনটাও বলা যেতে পারে ইউক্রেনে হামলা চালানোর অজুহাত হিসেবে রাশিয়া নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এর আগে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে ইউক্রেনের পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিসহ সেখানকার নাগরিকদের বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
কিন্তু অন্যান্য যুদ্ধ কিংবা আগ্রাসনের (ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার) ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোকে ভিন্ন ভূমিকায় দেখা গেছে। এজন্য এরই মধ্যে তাদের এ ধরনের দ্বৈতনীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বলা হচ্ছে, ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তা অন্যান্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। অর্থাৎ ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তান যুদ্ধকে যেভাবে দেখানো হয়েছে তার ঠিক বিপরীতভাবে দেখানো হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধকে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই পশ্চিমাদের এমন নীতির সমালোচনা করছেন।
অনেক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্বৈত নীতির অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে। কারণ রাশিয়ান সেনাদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াই বা প্রতিরোধকে কেবল প্রশংসার চোখেই দেখা হচ্ছে না বরং কীভাবে এমন সভ্য দেশের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অথচ অন্যযুদ্ধের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোকে কোনো নিষেধাজ্ঞায়ও পড়তে হয়নি।
এমএসএম/টিটিএন/জিকেএস