পরমাণু হুমকি কেন, পুতিন কি ভুল চাল দিলেন?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:২৭ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান পুরোপুরি পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে না। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে রুশ সেনারা। দক্ষিণে পুতিন বাহিনী কিছু অঞ্চল দখল করলেও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিয়েভের আশপাশে ইউক্রেনীয় বাহিনী অসংখ্য হামলা নস্যাৎ করেছে। ভ্লাদিমির পুতিন যাকে ‘মদ্যপ নাৎসি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন, সেই ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাজধানীতে বসেই আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রবল সাহস আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে গোটা জাতিকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছেন তিনি।
যুদ্ধের মাত্র প্রথম সপ্তাহ চলছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এখনো বাড়তি সেনা পাঠিয়ে কিয়েভ ঘিরে ফেলতে পারেন, বিপুল বেসামরিক মানুষের লাশের ওপর দিয়ে ইউক্রেনের শহরগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন, কিয়েভে পুতুল সরকার বসিয়ে ইচ্ছামতো ওঠবস করাতে পারেন। আগ্রাসী যুদ্ধে রাশিয়ারই এখনো জেতার সম্ভাবনা বেশি।
তবে বৃহত্তরভাবে দেখলে, পুতিন যে মুহূর্তে ইউক্রেন আক্রমণ করেছেন, সেই মুহূর্তেই যুদ্ধে হার হয়েছে তার। রুশ বাহিনীর হামলায় ইউক্রেনীয়দের মনে জেগে ওঠা দেশপ্রেম এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছে যে, পুতিনের হাত ধরে যে সরকারই আসুক, তাকে অবৈধ হিসেবে দেখবে দেশটির জনগণ। বিশ্বজুড়ে তিনি আরও বেশি অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠবেন। আর স্বদেশে, অগণিত নিষেধাজ্ঞার জালে আটকে পড়া এবং স্বৈরাচারী শাসনে পদদলিত এক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন।
ইউক্রেনের রাস্তায় রাশিয়ার ট্যাংক: ছবি সংগৃহীত
ধীরে ধীরে এটি পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, রাশিয়ার অভিজাতরা পুতিনের ‘বিকারগ্রস্ত অ্যাডভেঞ্চারের’ কারণে হতবাক এবং বিশাল আর্থিক ক্ষতির শিকার। ইউক্রেনে হামলার ফলাফল যত খারাপ হবে, তত দ্রুত পুতিন প্রশাসনে ফাটল দেখা দিতে শুরু করবে এবং রাশিয়ার জনগণ তত বেশি রাস্তায় নেমে আসবে। পুতিন যদি ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চান, তাহলে এত ভয়াবহ দমন-পীড়ন শুরু করতে বাধ্য হবেন, যা কয়েক দশকের মধ্যে দেখেনি রাশিয়া।
ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে রুশ প্রেসিডেন্টের প্রথম ভুল, শত্রুকে অবমূল্যায়ন করা। সম্ভবত তিনি নিজের প্রোপাগান্ডায় বেশি বিশ্বাস করেছিলেন যে, ইউক্রেন সত্যিই কোনো প্রকৃত দেশ নয়, এটি সিআইএ’র তৈরি এবং এর সরকারে রয়েছে একদল গুণ্ডা, যাদের প্রতি জনগণের বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই। পুতিন যদি বিশ্বাস করে থাকেন, রুশ সেনারা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কিয়েভ সরকারের পতন হবে, তাহলে এর চেয়ে বড় ভুল আর কিছু হতে পারে না।
পুতিনের দ্বিতীয় ভুল, তার নিজের সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে করতে না পারা। রুশ বিমান বাহিনী এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের আকাশে আধিপত্য বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে। পুতিন তার জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন যে, রাশিয়া কোনো যুদ্ধ করছে না। এটিকে তিনি ‘নাৎসিবিরোধী অভিযান’ বলে দাবি করেছেন। ফলে রুশ সৈন্যদের কাজ কী, তা তাদের কাছে পরিষ্কার হয়নি। পুতিনের কথায় সৈন্যরা হয়তো আশা করেছিলেন, ইউক্রেনে উপস্থিত হলে ‘মুক্তিদাতা’ হিসেবে তাদের স্বাগত জানাবে সেখানকার জনগণ। আবার, রুশ সৈন্যদের যদি গণহারে ইউক্রেনীয় হত্যার নির্দেশ দেন পুতিন, তবে অনেকেই তা না-ও মানতে পারেন। কারণ, ইউক্রেনে তাদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। এছাড়া, ইউক্রেন অভিযানে যদি প্রচুর রুশ সৈন্য প্রাণ হারায়, তাহলে সেটি দেশবাসীর কাছে গোপনও করতে পারবেন না পুতিন।
আক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুত ইউক্রেনীয় বাহিনী। ছবি সংগৃহীত
রাশিয়ার তৃতীয় ভুল, পশ্চিমা শক্তিকে অবমূল্যায়ন। পুতিন সম্ভবত ধরে নিয়েছিলেন, এটি খুবই ক্ষয়িষ্ণু শক্তি, যার প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষমতা নেই। একজন স্বৈরশাসক হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের বিশ্বাস বোঝা পুতিনের জন্য কঠিনই বটে। তিনি ইউক্রেনের প্রতি বিশ্বজুড়ে জনসমর্থনের উত্থান দেখে নিশ্চিত বিস্মিত হয়েছেন।
ইউক্রেনীয়দের সাহস দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং নিজ নাগরিকদের দাবির মুখে পশ্চিমা সরকারগুলো শেষপর্যন্ত পুতিনকে ঠেকাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ না নিলেও শক্তিশালী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে সম্মত হয়েছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারির ওই সিদ্ধান্তের ফলে দেশটির রিজার্ভ অ্যাক্সেস বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে।
কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার পরের দিনই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। সামরিক বাহিনী প্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীতে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছেন তিনি। পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে পারমাণবিক হামলার সঙ্গে তুলনা করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
এটি শুধু যে নৈতিকভাবে ভুল, তা নয়। এতে বিপর্যয় বাড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পুতিনের আগ্রাসী মনোভাবই প্রমাণ করে, তিনি কতটা বিপজ্জনক। রাশিয়ার এই হুমকি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীন-ভারতসহ সব পারমাণবিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে প্রতিহত করতে হবে। একই সময়, রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রভাবশালী দেশগুলোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে হবে এবং সতর্ক করতে হবে যে, কৃতকর্মের জন্য তাদের ব্যক্তিগতভাবেই জবাবদিহির মুখে পড়তে হবে। পুতিনের ভুলের জন্য সারা বিশ্ব খেসারত দিতে পারে না।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কেএএ/এএসএম