রয়েছো নয়নে নয়নে
তার নামটি রেখেছিলেন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক। তার সঙ্গে রাজনীতি করতেন চাষীর মামা চাষী ইমাম উদ্দিন। একদিন ফজলুল হককে একটা নাম দিতে বলা হলে তিনি চাষী ইমাম উদ্দিনের ‘চাষী’ আর কাজী নজরুল ইসলামের ‘নজরুল ইসলাম’ মিলিয়ে নাম দেন ‘চাষী নজরুল ইসলাম’। কে জানত সেই নাম একদিন এত বিখ্যাত হবে। মানুষটি হবেন এত সম্মানিত।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন চাষী নজরুল ইসলামেরই কথা বলছি। ঢাকাই ছবির ইতিহাসে উজ্জল এক নক্ষত্র ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই কোমর বেঁধে নেমেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। তার হাত ধরেই ১৯৭২ সালে ক্ষত শুকানোর আগেই রঙিন ফিতায় উঠে এসেছিলো মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির স্বজন হারানোর বেদনা, শোক, নি:স্ব হয়ে যাওয়ার করুণ দৃশ্য। তিনি তুলে এনেছিলেন স্বাধীনতার আনন্দ, মানচিত্রে জায়গা করে নেয়ার উচ্ছ্বাস। কেটে গেছে তারপর বহু বছর। তিনি ক্লান্ত হননি একচুলও। উপহার দিয়েছেন অসংখ্য দর্শকপ্রিয় আর কালজয়ী চলচ্চিত্র।
তবে মরনব্যাধি ক্যান্সারের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। দীর্ঘদিন লিভার ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসাধীন থেকে প্রিয় চলচ্চিত্র, প্রিয় মানুষজন আর কোটি ভক্ত-অনুরাগীর হৃদয় কাঁদিয়ে গেল বছরের ১১ জানুয়ারি পরপারে পাড়ি জমান নন্দিত চিত্রপরিচালক চাষী নজরুল। সময় ঘুরে আজ আবার সেই দিনের মুখোমুখি আমরা। প্রথম প্রয়াণ দিবসে তাকে স্মরণ করছেন সবাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর শ্রীনগর থানার সমষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। তার বাবার নাম মোসলেহ উদ্দিন খান। মা শায়েস্তা খানম। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
১৯৬৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের অন্যতম বিখ্যাত কাজী পরিবারের কে.জি. আহমেদের মেয়ে জোত্স্না কাজীকে বিয়ে করেন চাষী নজরুল ইসলাম।
১৯৫৫ সালে টাটানগরে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে প্রথম অভিনয় করেন প্রখ্যাত এই নির্মাতা। ১৯৬০ সালে ফতেহ লোহানীর সঙ্গে ‘আসিয়া’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর কাজ করেন ওবায়েদ উল হকসহ আরও অনেকের সঙ্গে। অভিনয়ও করেন কিছু ছবিতে। ১৯৭২ সালে পরিচালনা করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণাঙ্গ ছবি ‘ওরা ১১ জন’। ছবিটি দারুণ প্রশংসিত হয়। এরপর তিনি ‘সংগ্রাম’, ‘ভালো মানুষ’, ‘বাজিমাত’, ‘বেহুলা লক্ষিন্দর’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘হাসন রাজা’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘শান্তি’, ‘সুভা’র মতো সিনেমা নির্মাণ করেন।
১৯৮২ সালে বুলবুল-কবরী-আনোয়ারাকে নিয়ে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেছিলেন তিনি। সেটি আজও বাংলা ছবির ইতিহাসে অমর সৃষ্টি হয়ে আছে।
তিনি ছিলেন গর্বিত একজন মুক্তিযোদ্ধাও। তাই বোধকরি চলচ্চিত্র নির্মাণে এসে বরাবরই প্রাধান্য দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতা আদায়ের গল্পকে। বিভিন্ন প্রজন্মের কাছে তিনি নানা আঙিকে উপস্থাপন করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে। চাষী নজরুল ইসলাম সব মিলিয়ে ৩৫টির মতো ছবি নির্মাণ করেন। এর মধ্যে ছয়টি ছিলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক।
চাষী নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ আর ১৯৯৭ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন তিনি। ২০০৪ সালে ভূষিত হন একুশে পদকে। অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সংগ্রাম’ ছবির জন্য বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৪), শের-ই-বাংলা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৮), স্যার জগদীশচন্দ্র বসু স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জহির রায়হাণ স্বর্ণপদক (১৯৯৫) জহির রায়হান আজীবন সন্মাননা, আন্তর্জাতিক কালাকার পুরস্কার (২০০৫) প্রভৃতি।
চোখের দেখায় অদেখা হয়েও চাষী নজরুল ইসলাম রয়েছে এদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের অন্তরে অন্তরে। তারই প্রমাণ মিলে তাকে ঘিরে এফডিসিসহ চলচ্চিত্র ও শোবিজের মানুষদের স্মৃতিচারণ ও বর্ণিল সব আয়োজনে।
জানা গেছে আজ রাজধানীর মতিঝিলে প্রয়াত এই নির্মাতার নিজ বাসায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এরপর দুঃস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করবে তার পরিবার।
মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে রয়েছে এ ফাউন্ডেশনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান। এখানে চাষী নজরুল ইসলামের জীবন নিয়ে লেখা একটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হবে।
১৩ জানুয়ারি এফডিসিতে জহির রায়হান কালার ল্যাব মিলনায়তনে রয়েছে মিলাদ মাহফিল ও চাষী নজরুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান। এখানে অংশ নেবেন চলচ্চিত্রাঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা।
চাষীর মৃত্যুর পর গত বছর ‘অন্তরঙ্গ’ আর গত ৮ জানুয়ারি ‘ভুল যদি হয়’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। চাষীর নির্মাণ করে যাওয়া শেষ ছবি ছিলো এগুলো।
যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন সবার প্রিয় রুপালি মানুষ চাষী নজরুল ইসলাম। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি জাগো নিউজের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি রইল।
তথ্যসূত্র : অনলাইন
এলএ