সেই ডাক্তার ভাইয়ের হাসপাতালে এখনো সেবা পান হতদরিদ্ররা
গরিবের চিকিৎসক ডা. এড্রিক এস বেকার, মানবতার একটি বড় উদাহারণ। যেখানে মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ায় মত্ত সেই বাংলাদেশেই তিনি জীবনের বড় একটি অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডে জন্ম নেয়া এই মানুষটি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে মানবসেবায় এসে ভালোবেসে থেকে যান এই দেশে।
টাঙ্গাইলের মধুপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে ‘কাইলাকড়ী স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র’ নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে আমৃত্যু মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন তিনি। এলাকায় সবাই তাকে ডাকতেন ডাক্তার ভাই নামে। গত বছর ১ সেপ্টেম্বর এই মহান ব্যক্তি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে এড্রিক বেকারের জন্ম। তিনি ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করে চিকিৎসা দিতে চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। পরে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে চলে আসেন।
টাঙ্গাইলের মধুুপুরের প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া এলাকায় চিকিৎসা বঞ্চিত দরিদ্র লোকদের দেখে তার মন কেঁদে ওঠে। পরে সেখানে দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘কাইলাকড়ী স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র’।
এলাকার মানুষদের ভালোবেসে সেখানেই থেকে যান এবং একটানা ৩৬ বছর মানুষদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে এই হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে সারাজীবন থেকে যান চিরকুমার।
গরিবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাত এই মহান ব্যক্তিকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে নাগরিকত্ব প্রদান করেন। কাইলাকুড়ী গ্রামে চার একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালে মাটির ছোট ছোট ২৩টি ঘরে হাসপাতালের ডায়াবেটিক, শিশু, ডায়রিয়াসহ ৭টি বিভাগে ৪০ জন রোগী ভর্তির ব্যবস্থা আছে। এছাড়া প্রতিদিনই আউটডোরে শতাধিক রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়।
এদিকে ডাক্তার বেকারের মৃত্যুর পর এই হাসপাতাল নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে হাসপাতালের ৯৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। পরে তারা বেকারের নির্দেশনা মোতাবেক হাসপাতালের হাল ধরেন। বর্তমানে হাসপাতাল চলছে ডাক্তার বেকারের স্মৃতি নিয়ে। প্রতিদিনই দরিদ্র রোগীরা আসছেন আর চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। নতুন রোগীদের জন্য ২০ টাকা আর পুরাতনদের জন্য ১০ টাকা করে ফি নেয়া হচ্ছে।
এদিকে তার মৃত্যুর পর হাসপাতালটি চালাচ্ছেন তারই আদর্শের অনুসারীরা। ডাক্তার বেকারের অভাব সব সময় স্মরণ করেন রোগীরা। বেকারের অভাব কখনই পূরণ হবে না বলে জানান তারা। এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে প্রতিদিন রোগীদের প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়।
কাইলাকড়ী গ্রামের সুমেত আরা বলেন, আমরা কীভাবে কঠিন ও জটিল রোগ থেকে বাঁচতে পারি সেসব আমরা এই হাসপাতাল থেকে জানতে পারি। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা তা আমাদের বাড়িতে ব্যবহার করি। আর এতে করে আমার পবিবার অনেক ভালো আছি।
কাইলাকড়ী স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী সুজিত রাং সা বলেন, ডাক্তার বেকারের তিনটি শেষ ইচ্ছার মধ্যে দুইটি পূরণ হয়েছে। এই হাসপাতালটি টিকিয়ে রাখাই ছিল তার শেষ ইচ্ছা। তাই প্রতিষ্ঠানটির সেবা অব্যাহত রাখতে সরকারের সহযোগিতা চাইলেন এই কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমারদেরকে কোনো সমস্যার কথা জানাননি। যদি কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো সহযোগিতা চায়, তাহলে জেলা প্রশাসন অবশ্যই তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেবে।
ডাক্তার বেকারের ‘কাইলাকড়ী স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র’ হাসপাতালটি পাহাড়ি ওই অঞ্চলের সাধারণ গরিব ও দুখী মানুষের একমাত্র চিকিৎসা মাধ্যম। তাই প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে সরকারের জরুরিভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
বিএ