রাবির ‘স্বজন’ সবারই স্বজন
‘প্রাণ-প্রিয় মা ছালেহা খাতুন ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছেন। রাজধানীর শ্যামলী গেটের বিডিএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রক্তের গ্রুপ O(+)। তাকে বাঁচাতে সপ্তাহে প্রায় কয়েক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে রক্তের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান রিতু। কখনো কখনো রক্ত পেলেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে মুস্তাফিজকে। শত চেষ্টার পরও বাঁচাতে পারেননি বেঁচে থাকার অবলম্বন স্নেহময়ী মাকে। ইহকালের পাট চুকিয়ে পাড়ি জমান পরপারে।’
মুস্তাফিজুর রহমান তখন গভীরভাবে অনুভব করেন যদি এখন এমন কোনো সংগঠন বা কেউ থাকতো যে তার মায়ের রক্তের সংকুলান করতে পারতো, তাহলে হয়তো তার মাকে অকালে পৃথিবীর এই মায়া ত্যাগ করতে হতো না।
মুস্তাফিজুর রহমান যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, তখন তিনি মনে করেন এমন কিছু একটা প্রতিষ্ঠা করা যেটা রক্তের যোগান দেবে। আর কোনো মাকে রক্তের অভাবে অভাবে প্রাণ দিতে হবে না।
সময়টা তখন ২০০২ সাল। তিনি ‘স্বজন’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তখন স্বজনের স্লোগান ছিল ‘স্বজন সৃষ্টির প্রেরণা মা হারানোর বেদনা।’ প্রতিষ্ঠার সময় পাশে পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও এক ঝাঁক শিক্ষার্থীকে। প্রতিষ্ঠার পর এক পর্যায়ে একই বছরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বজনকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবেও অনুমোদন দেয়।
সেই সময় থেকে স্বজন এখন পর্যন্ত রক্তদানের মতো মহতী কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে বেড়েছে এই পরিবারের সদস্য। বেড়েছে তাদের কাজের পরিধি।
২০০২ সালে গুটি কয়েক শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই সংগঠনটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা সাড়ে এগারো হাজারেরও বেশি। এ পর্যন্ত স্বজনের সদস্যরা ১৫ হাজার একশো ১৩ ব্যাগ রক্ত প্রদান করেছে।
শুধু এটাই নয়। স্বজন রক্তদানের পাশাপাশি বেশ কিছু কাজও করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে বিসিএস পরীক্ষাকেন্দ্রিক প্রোগ্রাম ‘স্বজন পাঠচক্র’ পরিচালনা, রক্তদানে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কর্মশালা, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্লাড গ্রুপিং, প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি প্রভৃতি।
কথা হয় স্বজনের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে। হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ও স্বজন সদস্য রোকনুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। পাশাপাশি স্বজনে কাজ করছি। এমন একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করতে পেরে নিজেকে আমি গর্বিত মনে করি। মানুষের সেবায় নিজেকে কিছুটা হলেও নিয়োজিত করতে পারছি বলে মনে অন্য রকম প্রশান্তি আসে। যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’
এছাড়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী স্বজনের সঙ্গে কাজ করতে পারায় তাদের ভালো লাগা ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, আমরা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই মহতী কাজের সঙ্গে থাকতে চাই।
গত ২৭ ডিসেম্বর স্বজনের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রাবি চিকিৎসাকেন্দ্রর উপ-প্রধান চিকিৎসক ড. নাদিরা বেগম ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করেন। এতে মো. আশিকুল ইসলামকে সভাপতি, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রশীদকে সাধারণ সম্পাদক ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুন নাহারকে সাংগাঠনিক সম্পাদক করা হয়।
‘স্বজন’ এর নয়া সভাপতি মো. আশিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বজন একটি অরাজনৈতকি এবং অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। আমাদের দেশে রক্তদানে সক্ষম ব্যক্তিদের মাধ্যমে মাত্র আট লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আর যে কোনো জাতীয় উন্নয়নে সব সময় ছাত্র সমাজ গুরুত্বপূরণ ভূমিকা পালন করে। আর সেই ভূমিকা পালন করতে মানসিক সক্ষমতা তৈরি করতে স্বজনের সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে।’
রাশেদ রিন্টু/এসএস/আরআইপি