দেশ শাসনে কঠিন চ্যালেঞ্জে তালেবান
দীর্ঘদিনের সহিংসতার জের ২০২২ সালে এসে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে আফগানিস্তানে। যুদ্ধের মাঠের লড়াই শেষ হলেও এখন আরেক সংগ্রামের মধ্যে প্রবেশ করেছেন দেশটির নাগরিকরা। তালেবান সরকার রয়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। নারী শিক্ষায় অন্তরায়, নারীদের কাজের অধিকার, শান্তিবিষয়ক ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় বন্ধসহ বেশকিছু পদক্ষেপে ফের বিতর্কে তালেবান।
আমেরিকান ও ন্যাটো সৈন্যদের আফগানিস্তানের মাটি ছেড়ে যাওয়া, পশ্চিমা-সমর্থিত সরকারের পতন, তালেবানের প্রত্যাবর্তন এবং তাদের ইসলামি আমিরাতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সূত্রপাতের ঘটনা অতি দ্রুত নাটকীয়ভাবে ঘটে গেছে দেশটিতে। ফলে বুঝে ওঠার আগেই আরেক ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছেন আফগানরা।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলে নেয় তালেবান। এরপর ৩১ আগস্ট টানা ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশটি থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা। এরপর দেশের শাসনভার তুলে নেয় তালেবান।
আফগানিস্তান থেকে যখন সোভিয়েত সৈন্যরা পিছু হটে, তখন ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে উত্তর পাকিস্তানে এই তালেবান আন্দোলনের জন্ম। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান তালেবানের শাসনে ছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আল কায়েদার হামলার পর বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে তালেবানরা। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেন এবং তার আল কায়েদা আন্দোলনকে তালেবান আশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট সেখানে যৌথ অভিযান চালায়, যার মাধ্যমে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে।
তালেবানের আগের শাসনকালে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে অভিযোগগুলো ছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন এবং প্রকাশ্যে বিচার ব্যবস্থা। এবার ক্ষমতা নেওয়ার পরও একই ব্যবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যদিও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা পুরোনোদের মধ্যে অনেকেই দায়িত্ব নিয়েছেন।
দেশটিতে নারীদের আবারও কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে এবং নারী শিক্ষা আটকে আছে। তালেবান নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও বন্ধ করে দিয়েছে। শান্তিবিষয়ক ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ভেঙে দেওয়া হয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশনও। ফলে একদিকে যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা অন্যদিকে অর্থনীতির চরম বিপর্যয়।
খরা, করোনা মহামারি ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থার সমন্বয়ে চরম মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে দেশটিতে। সেই সংকট এখন ঘনীভূত হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টির কারণে।
নতুন ইসলামিক আমিরাত সরকারের কাছে অর্থ নেই। নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা। আফগানিস্তানের অর্থনীতি মূলত টিকে আছে বিদেশি সহায়তার ওপর। বিশ্বব্যাংক বলছে, সরকারি বিভিন্ন খাতের ৭৫ শতাংশ খরচই মেটে বিদেশি সহায়তা থেকে। তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর থেকে এসব সহায়তার বেশির ভাগই বন্ধ রয়েছে এখন।
কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আফগানিস্তানের জমা থাকা রিজার্ভের অর্থ জব্দ করে রেখেছে মার্কিন সরকার। ফলে সেই অর্থে হাত দিতে পারছে না তালেবান। বেঁকে বসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। আফগানিস্তানে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার তহবিল পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে তা স্থগিত করে দেওয়া হয়। আর্থিক সহায়তা বন্ধ রেখেছে বিশ্বব্যাংকও। যদিও সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক সেই অর্থ ছাড়ার কথা জানিয়েছে।
জাতিসংঘ জানায়, আফগানিস্তানের এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছে। সংস্থাটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, গত তিন বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো খরা দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস সামাজিক ও অর্থনীতিক পরিবেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে চরম বিধ্বস্ত দেশটি।
আমেরিকান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহন করা শেষ প্লেনটি কাবুল বিমানবন্দর ছাড়ার পর ওয়াশিংটন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করে। তবে একই সঙ্গে আফগানদের জীবনে সূচনা হয় কষ্টের আরেক অধ্যায়। আফগানিস্তানের উপর তালেবানদের সম্পূর্ণ দখল আছে, তবে তা ক্ষণস্থায়ী হতেও পারে এসব কারণে। দেশের অভ্যন্তরীণ ছোট ছোট গোষ্ঠীও মাথাচাড়া দিতে পারে। কারণ এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি তালেবান। আল কায়েদার সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক নতুনভাবে তৈরি হওয়া নিয়েও শঙ্কিত অনেকে। ফলে তালেবানের নতুন সরকার দেশে কতটা শান্তি ফেরাতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি
এসএনআর/এমএস