বেসরকারি কোম্পানিগুলোর লাগাম টেনে ধরছে চীন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:১৮ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১

চীনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ২০২১ সালে এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ এক হাজার কোটি ডলার বাজারমূল্য হারিয়েছে দেশটির বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কোম্পানিগুলো।

‘সাধারণ সমৃদ্ধির’ লক্ষ্যে আবাসন ব্যবসা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও বিনোদন- সবকিছুতেই নিয়ম-কানুন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ফলে আলিবাবা গ্রুপ, টেনসেন্ট হোল্ডিংস, দিদি চুজিং টেকনোলজি কোম্পানি, নিউ ওরিয়েন্টাল এডুকেশন অ্যান্ড টেকনোলজি গ্রুপ। বিশেষ করে জ্যাক মা ও পনি মার মতো করপোরেট নেতার আধিপত্য কমানোর চেষ্টা চলছে। এসব পদক্ষেপের ফলে অনেক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা চীনের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবন নিয়ে অনেকটা উদ্বিগ্ন।

jagonews24

ট্রিভিয়াম চায়নার একজন বিশ্লেষক ট্রে ম্যাকআর্ভার বলছিলেন, কোম্পানির জন্য, এর মানে হলো যে তাদের কাজ আর অর্থ উপার্জন নয় বরং সামাজিক পণ্যগুলোতে অবদান রাখা। যে কোম্পানিগুলোকে তা করতে দেখা যায় না তাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের সহযোগী অধ্যাপক কাইল জারোস বলেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এটা স্পষ্ট করেছে যে, ‘দল-রাষ্ট্র ব্যবসার শর্তাদি নির্ধারণ করতে পারে, অন্যভাবে নয়।’ তিনি আরও বলেন, এর অর্থ হলো ব্যবসায়িক কার্যকলাপের জন্য দল-রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত ও নৈতিক মানদণ্ড উভয় নির্ধারণের অধিকার রয়েছে। যেমন আলিবাবার জ্যাক মা-এর মতো লোকদের আধিপত্য কমানো, বেসরকারি সেক্টরকে নতজানু করে রাখা, যেমন টেনসেন্টের পনি মা এবং শাওমির লেই জুন।

চীনের আবাসন ব্যবসা

বেসরকারি ডেভেলপারদের নতুন ঋণ নেওয়া থেকে বিরত রাখার কৌশল হিসেবে ২০২০ সালের আগস্টে বেইজিং ‘থ্রি রেড লাইনস’ পলিসি চালু করে। ফলে এই আবাসন ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি হয়, অথচ হু হু করে গত কয়েক দশকে ফুলেফেঁপে উঠেছিল এই খাত।

jagonews24

ঋণের সীমাবদ্ধতাকে তারল্য সংকটের প্রাথমিক চালক হিসেবে ধরা হয়েছে যার ফলে চীনের সবচেয়ে বড় দুটি বেসরকারি কোম্পানি- এভারগ্রান্ড গ্রুপ ও কাইসা ঋণখেলাপি হয়। এছাড়া গত অক্টোবরে চীনের ছোট শহরগুলোতে ২৫০ মিটারের বেশি উচ্চতার গগনচুম্বী ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীন সরকার।

চায়না বেজ বুক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ কাজী বলেন, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বেইজিংয়ের অর্থনীতির পলিসি ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এতে স্বীকার করা যে চীনের পুরোনো ঋণ-জ্বালানি, বিনিয়োগ-ভারী বৃদ্ধির মডেল সীমানার বাইরে চলে গেছে।

চীনের প্রযুক্তি ব্যবসা

২০২০ সালের নভেম্বরে চীন প্রযুক্তি জায়ান্ট আলিবাবার ৩৭ বিলিয়ন শেয়ার ছাড়া স্থগিত করে দেয়। বেইজিং এটাকে বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আইপিও স্থগিতকরণ বলে অভিহিত করছে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের আর্থিক নিয়ন্ত্রক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে জ্যাক মার প্রকাশ্য সমালোচনা এই পদক্ষেপের সূত্রপাত করেছে।

ওরিয়েন্ট ক্যাপিটাল রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্ড্রু কোলিয়ার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, স্থগিতাদেশটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে রক্ষার জন্য হতে পারে যে আলিবাবা অ্যান্ড গ্রুপকে ফি প্রদান করে তাদের নিজস্ব লাভের মূল্যে গ্রাহকদের কাছে ঋণ প্রসারিত করতে সহায়তা করার জন্য। তিনি আরও বলেন, যে ব্যাংকগুলো একটি অজুহাত খুঁজছিল।

jagonews24

গত ফেব্রুয়ারিতে বেইজিং নতুন একচেটিয়া বিরোধী নিয়ম প্রকাশ করেছে। যদি আলিবাবা, টেনসেন্ট এবং বেইদুর মতো টেক জায়ান্ট নিয়ম ভঙ্গ করে তাহলে জরিমানা করা হবে। চীনের সেন্ট্রাল ব্যাংক মনিটরিং করবে তাদের কার্যকলাপ। বিদেশি শেয়ারের অনুমোদনও দেবে না চীন। ডাটা সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও আনা হয়েছে নতুন নিয়ম। গত আগস্টে বেইজিং গেমিংয়ে আসক্তি কমাতে ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে তিন ঘণ্টার বেশি ভিডিও গেম খেলা নিষিদ্ধ করে।

চীনের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ

বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধের পর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকদের নজরদারির আওতায় এনেছে চীন। গত জুলাইয়ে এক বিবৃতিতে ক্লাসের বাইরে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো বা প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের সতর্কবার্তা দিয়েছে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিধিনিষেধের পর দেশটিতে ১২০ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্য কমে গেছে কোচিং ফার্মগুলোর। বিশেষ করে নিউ ওরিয়েন্টাল এডুকেশন অ্যান্ড টেকনোলজির। চীনের এই সবচেয়ে বড় প্রাইভেট টিউটরিং ফার্মটি যুক্তরাষ্ট্রের তালিকা অনুযায়ী, ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন বাজারমূল্য হারিয়েছে।

jagonews24

চীনের বিনোদন ব্যবসার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ

গত আগস্টে, বিশৃঙ্খল সেলিব্রিটি ফ্যান সংস্কৃতি রোধে বেইজিং সম্প্রচারকারীদের ‘ভুল রাজনৈতিক অবস্থান’ এবং ‘বিদ্বেষপূর্ণ’ শৈলীযুক্ত বিনোদন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কাজ না করার নির্দেশনা দেয়। বেইজিং বিতর্কিত পারফরমারদের জন্য পণ্য বিক্রিও নিয়ন্ত্রণ করে এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে জনপ্রিয়তা তালিকা প্রকাশ করতে বাধা দেয়।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামাজিক মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিন শেষ হচ্ছে। যে ব্যবসায়ীরা এসব নিয়মকানুন মানিয়ে নিতে পারবেন তারা সফল হবেন।

অধ্যাপক কাইল জারোস আরও বলেন, চীনের কঠোর ব্যবস্থাপনার কারণে কিছু কোম্পানি অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ও চাপের পরিবেশের মুখে থাকবে। ফলে তারা উদ্ভাবনের সুযোগ সীমিত করতে পারে, বিনিয়োগ কমাতে পারে বা চীনের বাইরে আরও খোলা বাজারের সন্ধান করতে পারে।

সূত্র: আল-জাজিরা

এসএনআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।