সাঈদীর রায়ে প্রসিকিউশনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন!


প্রকাশিত: ০৭:২৬ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাঈদীর রায় মৃত্যুদণ্ড না হয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড হওয়ার পেছনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তারা ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছেন প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে।

রায়ে আদালতের অভিমতে বলেন, মামলার প্রসিকিউটর একজন শিক্ষানবীশ আইনজীবীর মতো কাজ করেছেন, মামলা পরিচালনায় যোগ্যতা যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, মামলা নিয়ে উদাসীনতা করেছেন। প্রসিকিউশনের ব্যর্থতার গুরুত্ব দিয়ে আরও বলা হয়, প্রসিকিউশন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করেননি এবং চিফ প্রসিকিউটর তখন যথাযথ ব্যবস্থা নেননি।

সাঈদীর মামলায় প্রসিকিউশন ও তদন্তের দুই টিমের গাফিলতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘আমরা বেশ কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি লক্ষ করেছি। তদন্ত কর্মকর্তা ইব্রাহিত কুট্টি হত্যার অভিযোগের বিষয়ে মমতাজ বেগমের করা এজাহার সংগ্রহে কার্যকর কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি। একইভাবে প্রসিকিউটরও কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি (প্রসিকিউটর) কোনো তদন্ত করেননি যে, মমতাজ বেগমের করা ওই এজাহার সত্য কিংবা মিথ্যা। তিনি এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছেন।

রায়ে বলা হয়, ‘এটা মনে রাখার দরকার যে, রাষ্ট্র মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সামনে অপরাধীদের মুখোশ উম্মোচন ও সঠিক ইতিহাস লেখার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। রায়ে আরো বলা হয়, আমাদের অভিমত প্রসিকিউটর একজন শিক্ষানবীশ আইন কর্মকর্তার মতো কাজ করেছেন। তার মধ্যে মামলা পরিচালনার যোগ্যতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তিনি এ মামলাকে উদাসীনতার সঙ্গে করেছেন। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করেননি। চিফ প্রসিকিউটর তখন যথাযথ ব্যবস্থা নেননি।

রায়ে বলা হয়, তিনি (চিফ প্রসিকিউটর) যদি যথাযথভাবে তদারকি না করেন তবে তার এই অফিসে থাকার প্রয়োজন নেই। প্রসিকিউশন অফিস শহীদদের রক্তের সঙ্গে জুয়া খেলতে পারে না। এই মামলার মতো অন্য মামলাও তারা যেভাবে পরিচালনা করেছেন তাতে আমরা মর্মাহত। এটা মনে রাখা দরকার যে এসব মামলার পরিচলানার সঙ্গে জড়িতরা অতিরিক্ত অর্থসহ অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করেছেন। ভবিষ্যতে তাদের সরকারি কোনো দায়িত্ব দেয়া উচিত না।’

রায়ে বলা হয়, সরকার জনমতের দিকে তাকিয়ে এই বিচারের ঝুঁকি নিয়েছে। তাই বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ঝুঁকিভাতা দিয়েছে। প্রসিকিউটরদের দায়িত্ব ছিল যথাযথ আইনি সাক্ষ্য সংগ্রহ করা। এটায় তারা ব্যর্থ হয়েছে।

রায়ে তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতার সম্পর্কে বলা হয়, তদন্ত সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অযোগ্য তদন্ত কর্মকর্তাকে কোনো মামলার সঙ্গে রাখা ঠিখ হবে না। তাকে এখনই সরানো উচিত। অন্যথায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা সুবিধা নেবে।

আপিল আদালত সাঈদীর দণ্ড কমানোর বিষয়ে বলেন, সাঈদীর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করার মতো নয়। এ কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়াই যুক্তিযুক্ত বলে আদালত মনে করেছেন।’

প্রসিকিউশনের ব্যর্থতায় সাঈদীর দণ্ড কমার যুক্তি
সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা বলেন, ইব্রাহিম কুট্টি বিষয়ে আসামিপক্ষ যে ফটোকপি দাখিল করছে, সটা যে ভুয়া তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও ওই দলিলটা আমরা সন্দেহাতীতভাবে ভুয়া বলে মনে করি। তবে রাষ্ট্র এটা ভুয়া প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটা অপরাধেই সে অপরাধী অন্য অপরাধগুলো যে ভুয়া তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। অনেক অপরাধই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার বেনিফিট অব ডাউট সাঈদী পেতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে আমরা মনে করি আমৃত্যু কারাদণ্ডই তার জন্য উপযুক্ত।

বেকসুর খালাস দিয়ে বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার লেখা রায়ে বলা হয়েছে, আসামি পক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে, ১৯৭১ সালের মধ্য জুলাইয়ের পূর্বপর্যন্ত দেরাওয়ার হোসেন সাঈদী যশোরের বাঘারপাড়া থানার দোহাখোলা গ্রামের রওশন আলীর বাড়িতে ছিলেন। তিনি মধ্য জুলাইয়ের পর পিরোজপুরের পাড়েরহাটে যান। অর্থাৎ সাক্ষ্য দ্বারা আসামি পক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে যে অপরাধ সংঘটনের সময় আসামি সাঈদী ঘটনাস্থলে ছিলেন না।

রায়ে বলেন, ‘আসামি ঘটনাস্থলে ছিলেন এটা আগে বিবেচ্য বিষয়। আসামি ঘটনাস্থলে ছিলেন এবং রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এটা প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন। তাই আসামির করা আপিল মঞ্জুর করা হলো। রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করা হলো।
তিনি বলেন, মুক্তযুদ্ধ চলাকালে পুরো সময়ই রাজশাহীতে ছিলো এটা সাক্ষীদের অবিশ্বাস করার মতো কোন কারণ খুজে পাওয়া যায়নি।

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসির দণ্ড পরিবর্তন করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এক বছরেরও বেশি সময় আগে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ রায় দেন। ওইদিন আদালত সংক্ষিপ্ত রায় দেন।

বৃহস্পতিবার এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের (বর্তমানে অবসরে) নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সাঈদীর মামলায় রায় ঘোষণা করেন। এ বেঞ্চের অপর সদস্য ছিলেন বিচারপতি এস কে সিনহা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। সাঈদীর রায়ে বলা হয়, সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে এই রায় দেয়া হয়।

বেঞ্চের ৫ বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী অবসরে গেছেন। এ ৫ বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচাপরতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী একমত হয়ে রায় দেন। তারা মৃত্যুদণ্ডের সাজা পরিবর্তন করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন।

এ তিনজনের মধ্যে মূল রায় লিখেছেন বিচারপতি এস কে সিনহা। তার সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচাপরতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এবং সাঈদীকে খালাস দিয়ে রায় দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। আর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন।

মোট ৬শ ১৪ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা লিখিছেন ১৫২ পৃষ্ঠা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা লিখেছেন ২শ ৪৪ পৃষ্ঠা এবং বিচারপতি বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন ২শ ১৮ পৃষ্ঠা। এ তিনটি রায় সমন্বয় করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।

এফএইচ/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।