ছবিটা বদলাতে হবে ধীরে ধীরে
শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ছিল বিশ্ব অভিবাসী দিবস। বেশিদিন হয়নি আমাদের দেখতে হয়েছে কাজের জন্য বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে সাগরে ভাসছে মানুষ। তাই বাংলাদেশ যেভাবে দেখেছে এই দিবসকে, তার চেয়ে আলাদা ছিল না বিশ্ব পরিস্থিতিও। সাগরে ভেসে শরণার্থীরা সিরিয়া থেকে, লিবিয়া থেকে, ইরাক থেকে, আফ্রিকা থেকে মানুষ ছুটেছে ধনী দেশগুলোর দিকে। কেউ আশ্রয় পেয়েছে, কেউ পাওয়ার লড়াই করছে।
পশ্চিমা গণমাধ্যম বেশি বেশি করে প্রচার করেছে শিশুদের দুরাবস্থার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব এখন সবচেয়ে কঠিন শরণার্থী সমস্যা মোকাবেলা করছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যাসংকুল জীবন এখন শরণার্থী শিশুদের।
যেকোনো সংঘর্ষে, সংঘাতে, সহিংসতার সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। এক বছর আগে সিরিয়া থেকে যে শিশুটি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছে, কেউ বাবা মা হারিয়েছে, কেউ তার খেলার সাথীর মৃতদেহ পথে পড়ে থাকতে দেখেও বাবা মা’র হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে, কিংবা বাংলাদেশের যে শিশুটি দেখেছে পেট্রল বোমায় ঝলসে যাওয়া তার পিতার মুখ, সে আজ এক বছর বড়। এক বছরে একটু লম্বা হয়েছে, কিন্তু সময়ের চেয়ে বেশি বেড়েছে তার অভিজ্ঞতা। দেখেছে কি কঠিন জীবন বাবার পঙ্গুত্ব বা তার হারিয়ে যাওয়া। তার চোখ এখন অনেক শানিত, সে জানে তার জীবনে আরো কঠিনতর সময় আসন্ন। রাজনীতি সে এখনো বোঝে না, কিন্তু সময়ের আগেই বুঝে নেবে। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর কোনোদিন হয়তো পাবে না, যারা পেট্রল বোমা মেরে এক একটি পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেছে, সেই পরিবারগুলোর কি ভূমিকা ছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বা অন্যকোনো রাজনৈতিক সমীকরণে?
সংঘাত আর সহিংসতা ছাড়া কোনো একটি দিন পাওয়া যাবে এমন সময় বোধ হয় চলে গেছে। অনেকটা এমন কথাই বলেছেন স্কটিশ ইতিহাসবিদ নিয়াল ফারগুসান তার ‘ওয়ার অব দ্যা ওয়ার্লড’ বইতে। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও এখন যুদ্ধ আছে। বাংলাদেশেও কোথাও না কোথাও এখন আতংক আছে। এই সংশয়, এই আতংক, এই অনিশ্চয়তা যারা সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী তাদের রাজনৈতিক দর্শন প্রায় এক – ‘ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক অংকের সমাধান’। তাই যারা বাংলাদেশের গাজীপুরে কিশোর মনিরকে তার বাবাসহ সিএনজি অটো রিকশায় পুড়িয়ে মারে, গাইবান্ধায় কোলের শিশুকে মায়ের কোলেই যারা স্তব্ধ করে দেয়, শিশু মাইশা সমুদ্রে দেখে ফেরার পথে যাদের দ্বারা অঙ্গার হয়, তাদেরই জ্ঞাতি ভাইরা পেশোয়ারে স্কুলে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তারাই ক্যালিফার্নিয়ায় প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্রে ঢুকে নির্বিচার গুলি করে। এরাই আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া বা লেবাননে আগুন নিয়ে খেলে। বাংলাদেশের আগুন সন্ত্রাসী আর সিরিয়ার আইসিস, কোনো পার্থক্য করা যায় না।
অংক করে আর পরিসংখ্যান দেয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে এমন ঘটনা। বলা হচ্ছে এরা নন-স্টেট টেররিস্ট। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস হামলার পর সর্বোচ্চ সতর্কতা। বলা হচ্ছে, আগামী দিন কি ঘটবে তার প্রস্তুতি নয়, এখন কি ঘটতে যাচ্ছে সেভাবেই প্রস্তুত নিরাপত্তা বাহিনী।
আমরা জানতান মানুষের সৃজনশীলতা সীমাহীন। এই একুশ শতকে দেখছি, মানুষের খুন করার ক্ষমতা কোনো সীমাই জানে না। প্রাচীনকালে বলা হতো সব পথ রোমে গিয়ে মিলেছে। তাহলে এখনকার পথ কোথায় মিলেছে? ইরাকে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে, সিরিয়ায়, লিবিয়ায়? নাকি বাংলাদেশও আছে পথের সাথে মিলতে? যদি শক্ত হাতে, কঠিন বিশ্বাসে এদের উপড়ে ফেলা না যায়, তবে পথ এখানেও এসে মিলবে, এই আশংকা আছে, কারণ ফ্রাংকেইস্টাইনরা সাধারণের চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইসলামোফোবিয়ায় ভুগেন, বলেন মুসলমানদের আমেরিকায় ঢুকতে দেয়া যাবে না, তখন স্বভাবতই এমন সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের নিন্দা হয়। কিন্তু একইসাথে দায়িত্ব বাড়ে এই ধর্মের মানুষদের এই ভয় ভাঙ্গানোর। আবার ট্রাম্প সাহেব যে দেশের মানুষ সেই দেশের নেতৃত্বের কাছে প্রশ্ন উঠে তাদের কোনো কোনো নীতি আর কাজের কারণে এমন শক্তি দানবের মতো বিশ্বকে আজ খুবলে খাচ্ছে?
বাংলাদেশে যারা তালেবান হয়ে আফগান বানাবার স্বপ্ন দেখেছিল তারা এখন কি স্বপ্ন দেখে? দেশ কি সিরিয়া হবে? স্বাধীনতার লড়াইয়ে বিজয়ের ৪৫ বার্ষিকীতে মানুষের শক্ত উচ্চারণ তারা তা হতে দেবে না। রাজনীতির মূলধারায় প্রকাশ্যে সম্মান করতেই হবে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় চরিত্রটিকে। পেট্রল বোমার মতো মারাত্মক হিংস্রতা বা আগুন সন্ত্রাস, শিয়া মসজিদে, হিন্দু মন্দিরে হামলার মতো উগ্রতা যারা করে বুঝতে হবে এরা রাজনীতি হোক আর অন্য যেকোনো বিষয় হোক তারা কখনোই যুক্তিতে শানিত নয়।
এতো এতো মানুষের মৃত্যু হলো আগুন সন্ত্রাসে, আমরা কোনো সমাধি করিনি। কতইবা করবো? সন্ত্রাস, সহিংসতা বা খুনাখুনি যারা করে তারা হয়তো সমাধি দেখতে চাইবে, কারণ এসব দেখে দেখে উল্লাসের একটা উপলক্ষ খুঁজতে চাইবে তারা।
সংখ্যালঘুর প্রতি, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্তচিন্তা বা বাক্ স্বাধীনতার ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা, ধর্মপরিচয় নিয়ে বাড়াবাড়ি সবই সমাজের পশ্চাৎপদতার সঙ্গে যুক্ত। ছবিটা ধীরে ধীরে বদলাতে হবে। সুশীল, শিক্ষিত, প্রত্যয়ী সব মুখের মিলন প্রয়োজন। যারা পশ্চাৎপদ তাদের সাংস্কৃতিক মূলধারায় আনা জরুরি। মোল্লা-মৌলবীদের মুঠি আলগা করার এর চেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি আর নেই।
পরিবর্তন নিরপেক্ষ শব্দ। প্রয়োজন প্রগতি। প্রগতি শব্দটি ইতিবাচক। কিন্তু, পরিবর্তন যদি সদর্থে প্রগতি আনতে না পারে, তবে তার মানে দাঁড়ায় একই জায়গায় ঘুরে চলা। বা, পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়া। একটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি না হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সমাজের সার্বিক অগ্রগতি থেমে যায়। আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজে এমন একটা শ্রেণি ছিল, দরকার শুধু তাদের আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনা।
এইচআর/এমএস