নতুন আফগান সরকারকে স্বাগত চীনের, নীরব ভূমিকায় পশ্চিমারা
আফগানিস্তানে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছে তালেবান। এর পরপরই চীন আফগান সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে বিশ্বের অন্যান্য দেশ। নতুন আফগান সরকার গঠনের পাঁচদিনের মাথায় অর্থাৎ গত রোববার কাবুল সফরে যান কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি এবং এরপর তিনি আফগান প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসান আখুন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কিন্তু দোহায় ফিরে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দেন, তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। অন্যদিকে, তালেবানকে মদত দিচ্ছে বলে যে দেশের প্রতি বার বার অভিযোগ আনা হয়েছে, নতুন কাবুল সরকার নিয়ে সেই পাকিস্তানের ভূমিকাও অস্পষ্ট।
পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রধান লে. জেনারেল ফায়েজ হামিদ গত সপ্তাহে কয়েকদিন কাবুলে ছিলেন। এরইমধ্যে বিমান বোঝাই করে আফগানিস্তানে খাবার এবং ওষুধ পাঠিয়েছে পাকিস্তান। সোমবার পাকিস্তানের জাতীয় বিমান সংস্থা পিআইএর একটি বিমান কাবুলে নেমে যাত্রী নিয়ে এসেছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছে যে এখন থেকে নিয়মিত এই রুটে বিমান চলবে।
কিন্তু তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে ইসলামাবাদ এখনও চুপ। কিন্তু তালেবানের কাবুল দখলের ঘটনায় প্রকাশ্যেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে চীন। তালেবান সরকার গঠনের পরদিন অর্থাৎ বুধবার তারা তালেবান সরকারকে স্বাগত জানায়।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েন বিন একে অরাজকতা বন্ধের জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন। কাবুলে চীনা দূতাবাস চালু রয়েছে। নতুন আফগান সরকার এবং তাদের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে বেইজিং।
যেভাবে তালেবান সরকার গঠন করেছে বা সেই সরকার এখন পর্যন্ত যেভাবে আচরণ করছে, তা নিয়ে চীন কোনো বিরোধিতা করেনি। লন্ডনে আফগান সাংবাদিক এবং আফগানিস্তান রাজনীতির বিশ্লেষক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিজামী বলেন, কয়েকটি দেশ বিশেষ করে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন এবং পাকিস্তান তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কোন প্রতিশ্রুতি এখনও তারা দিচ্ছে না।
নিজামী বলেন, দেখে মনে হচ্ছে একটি দেশ যেন আরেক দেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তারা কী করে। একজন সিদ্ধান্ত নিলেই আরেকটি এগুবে। পাকিস্তান তাকিয়ে আছে চীনের দিকে, চীন হয়তো দেখছে পাকিস্তান কী করে। উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান চেয়ে আছে সম্ভবত রাশিয়ার দিকে।
আর যে সৌদি আরব বাকি বিশ্বের তোয়াক্কা না করে ১৯৯৬ সালে তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, এবার তারা তালেবানের কাবুল দখলের পর একটি কথাও বলেনি। কাতারের সঙ্গে তালেবানের দহরম মহরম হয়তো সৌদির পছন্দ হচ্ছে না।
স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক কেন পাকিস্তান?
১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ওই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। আবার পাকিস্তানই তালেবানের জন্য সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের স্বীকৃতি আদায় করেছিল। কিন্তু এবার তালেবানের কাবুল দখলের এক মাস পরও স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ইসলামাবাদ এখনও চুপ।
ইসলামাবাদে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভী বলেন, পাকিস্তান তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না। তারা এবার একা কিছু করতে চায় না। অন্য আরও দশ-পাঁচজনের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে চায়।
প্রতিবেশী অন্য দেশগুলো, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে সমন্বয় করে এবার এগুতে চাইছে পাকিস্তান। আফগান এবং তালেবানের প্রশ্নে কমপক্ষে আঞ্চলিক একটি ঐক্য চাইছে পাকিস্তান। সম্ভবত সে কারণেই পাকিস্তানের উদ্যোগে বুধবার চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি বৈঠক করেছেন।
দু'দিন পর শনিবার আবারও পাকিস্তানের উদ্যোগেই এসব দেশের গোয়েন্দা প্রধানরা একটি বৈঠক করেন বলে পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য ইংরেজি দৈনিক ডন খবর দিয়েছে। আমেরিকার সাথেও গোপনে পাকিস্তান কথা বলছে বলে ডনের খবরে বলা হয়েছে।
বুধবার যখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে কথা বলছেন, সেদিনই সিআইএর প্রধান উইলিয়াম বার্নস ইসলামাবাদে ছিলেন। বার্নস আফগান পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার রশীদ বাজওয়া এবং আইএসআই প্রধান লে. জেনারেল ফায়েজ হামিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
তালেবানকে গত ২০ বছর ধরে পাকিস্তানই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে শক্তিধর করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও পাকিস্তান তা সবসময় অস্বীকার করেছে। সে কারণেও এবার আগ বাড়িয়ে পাকিস্তান এককভাবে তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে না বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন।
তিনি বলেন, তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে ধীরে চলো নীতি নিলেও পাকিস্তান আফগানিস্তানকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাকিস্তানের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। সীমান্ত খোলা থাকায় প্লেন ভরে ত্রাণ গেছে।
তাছাড়া পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে আটকে রাখা আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কোন শর্ত ছাড়াই আফগানিস্তানে মানবিক সাহায্য দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে চীনের অপেক্ষা কেন?
তালেবান সরকার গঠনের পর একমাত্র যে দেশটি খোলাখুলি অভিনন্দন জানিয়েছে, সেটি হচ্ছে চীন। গত সপ্তাহে চীন আফগানিস্তানের জন্য তিন কোটি মার্কিন ডলারের জরুরী খাদ্য এবং ওষুধ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আফগানিস্তানে বিনিয়োগ নিয়ে দোহায় তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত সপ্তাহে চীনাদের কথা হয়েছে বলে জানা গেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ তাই বলছেন যে, তালেবান সরকারের প্রতি পাকিস্তান, চীন বা কাতারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অনেকটাই এখন অপ্রাসঙ্গিক, কারণ সম্পর্ক শুরু হয়ে গেছে। তবে কুয়ালালামপুরে চীনা রাজনীতির বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন যে, তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে চীন ধৈর্য ধরবে এবং জাতিসংঘের আওতায় একটি ঐক্যমত্য সৃষ্টির চেষ্টা তারা হয়তো করতে পারে।
মাহমুদ আলী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পরাজয়ে চীন হয়তো খুশি, কিন্তু আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ভিন্ন একটি বিষয়। একটি যুদ্ধের মাধ্যমে তালেবান ক্ষমতা হয়তো নিয়েছে, কিন্তু তাদের সরকার কি পুরো আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? তাদের জনসমর্থনের মাত্রা তো এখনও নিশ্চিত নয়। আফগানিস্তানের ইতিহাস চীনের জানা এবং চীনারা ইতিহাসকে গুরুত্ব দেয়। তারা তাড়াহুড়ো করবে না।
স্বীকৃতি পেতে অধৈর্য তালেবান
তবে বৈধতা এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য তালেবান উন্মুখ হয়ে পড়েছে। তারা মনে করছে, সরকার পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশের, বিশেষ করে প্রতিবেশী কিছু দেশের স্বীকৃতি জরুরি। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইয়েদ নিজামী বলেন, রোববারও টেলিফোনে তালেবানের শীর্ষ মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বৈধতা এবং স্বীকৃতির জন্য তালেবান উন্মুখ হয়ে আছে।
তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী আমির খান মুত্ত্বাকি দু'দিন আগে আফগান কূটনীতিকদের বিদেশি মিশনগুলোতে কাজে যোগ দিতে বলেছেন, কিন্তু আফগান দূতাবাসগুলো এখন কার্যত অচল। এমনকি লন্ডন এবং ওয়াশিংটনেও আফগান দূতাবাসে কোন কূটনৈতিক তৎপরতা নেই। বলতে গেলে বন্ধ। ইসলামাবাদে দূতাবাস সচল। আবার তাজিকিস্তান এবং ইতালিতে আফগান রাষ্ট্রদূতরা তাদের ইচ্ছামত তালেবান বিরোধীদের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। অরাজকতা এখনও চলছে।
তিনি আরও বলেন, মানবিক সাহায্যের আশ্বাস থাকলেও কাবুল সরকারের হাতে নগদ টাকা নেই। বিদেশের সাথে ব্যাংকিং কাজ করছে না। অনেক সরকারি কর্মচারী কাজে ফিরলেও বেতন পাচ্ছেন না। কবে পাবেন, তা নিয়েও চরম অনিশ্চয়তা রয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাবে আফগানিস্তানের অর্ধেক মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের হুমকির মুখে রয়েছে। কারণ গত ২০ বছর ধরে আমেরিকা এবং পশ্চিমা যে সাহায্যের ওপর আফগানিস্তান ভর করে ছিল, তা রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক মানুষের কাছে খাবার কেনার টাকাও নেই।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা বলছে, দ্রুত ত্রাণ এবং সাহায্য না গেলে ৯৭ শতাংশ আফগান দারিদ্র সীমার নিচে চলে যেতে পারে। এই হার এখন ৭২ শতাংশ।
তালেবানের জন্য একমাত্র আশার কথা যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সিংহভাগ পশ্চিমা মিত্র এখনও তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি নাকচ করছে না। ফ্রান্স এবং ডেনমার্ক ছাড়া কোন দেশই বলেনি যে তালেবানকে কখনই মেনে নেবে না।
তবে মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিশ্চিত করা এবং আইএস ও আল-কায়েদার মত গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার শর্ত আরোপ করছে তারা এসব নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে তালেবান চীন ও রাশিয়ার পুরোপুরি মুখাপেক্ষী হতে পারে এ ভয়ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে।
এ কারণেই হয়তো আমেরিকা বলছে যে তারা আফগানিস্তানে মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখবে, তবে সেই সাহায্য যাবে শুধুমাত্র জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে।
বিভিন্ন আফগান জাতিগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু এবং ভিন্নমতের লোকজনকে তালেবান তাদের সরকারে শেষ পর্যন্ত কতটা জায়গা দেবে তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাদের শিক্ষানীতিতে নারীদের শিক্ষার অধিকার মেনে নিয়েছে তালেবান, যদিও নির্দেশ দিয়েছে যে নারী-পুরুষ একসঙ্গে ক্লাসে বসতে পারবেন না।
তবে বৈধতা এবং স্বীকৃতি পেতে তালেবানের আসল পরীক্ষা হবে সন্ত্রাস নিয়ে তাদের অবস্থানের ওপর। কারণ শুধু আমেরিকা নয়, এই ইস্যুতে চীন, রাশিয়া এমনকি পাকিস্তানও কমবেশি উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে, আরেক প্রতিবেশী ইরান চায় আইএস এবং আল-কায়েদা যেন আফগানিস্তানে না থাকে। আর রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর চাওয়া হলো, আইএসকে (ইসলামিক স্টেট-খোরাসান) যেন কোনওভাবেই আফগানিস্তানে প্রশ্রয় না পায়। সুতরাং এক মাস আগে কাবুল দখল তালেবানের জন্য যতটা সহজ ছিল, বৈধতা অর্জন ও দেশ শাসন করা হবে ততটাই জটিল এবং কঠিন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিটিএন/এমএস