মুক্তিযুদ্ধের গৌরব নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই


প্রকাশিত: ০৯:৪০ এএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

খুলনার বয়রায় প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে ১১টি বন্দুক দিয়ে পরপর ফায়ার করে পাক সেনাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। তাদের আত্যাধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমাদের কাছেও ভারি অস্ত্র আছে। কিন্তু বন্দুক ও বাঁশের লাঠি নিয়ে তাদের সঙ্গে পেরে উঠিনি।

এভাবেই আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ খুলনার বয়রা এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে সংগঠিত প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়া শেখ মোশাররফ হোসেন (৬০)।

অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে বন্দুক দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে পারিনি। আমাদের মধ্য একজন মারা যান, আহত হন দুইজন। তবে সেই স্বীকৃতি চাই না, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, এই গৌরব নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।

২৭ মার্চের সম্মুখযুদ্ধে আমাদের বাড়ির ১০ জন অংশ নেন। আমরা দিনের পর দিন শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়াসহ সবধরনের সহযোগিতা করেছি। যুদ্ধ করায় বাড়িঘর, দোকানপাট সব লুট করে নিয়ে গিয়েছিল পাক বাহিনীর দোষররা। পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হই। কিন্তু এসবের কোনো স্বীকৃতি পাইনি। দরকারও নেই এখন।

যুদ্ধকালে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের বার্তা বাহকের কাজও করেছেন বর্তমানে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ মোশাররফ হোসেন।

মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, যুদ্ধের আগে থেকেই খুলনার বয়রা এলাকা ছিল আওয়ামী লীগের একটি বিশাল ঘাঁটি। এখানেই রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো ভাই শেখ আবু নাসের, মীর্জা খয়বার, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর বাড়ি।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর সারা দেশ উত্তাল হয়ে যায়। সে সময় পাক বাহিনী খুলনায় ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে বয়রার ফায়ার সার্ভিসের বাড়িটি। ভাষণের পর আমরাও সংগঠিত হতে শুরু করি। খবর পাই যে যশোর সেনা নিবাস থেকে পাক বাহিনী খুলনায় আক্রমণ চালাবে। আমরাও সেভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি। ২৫ মার্চের কালো রাতের পর আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, খুলনায় আক্রমণ হবে। মাইকে প্রচারও করা হয় সে কথা। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় ৭২ ঘণ্টার কার্ফিউ। সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে বয়রা এলাকার তিনটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন।

মোশাররফ হোসেন স্মৃতিচারণ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মীর্জা খয়বারের নেতৃত্বে নগরীর বয়রা এলাকার বৈকালী জংশন, বর্তমান পিএমজি অফিস, ও সেক্রেটারিয়েট এলাকায় পাক সেনাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তিন দলের মধ্য বৈকালী জংশন এলাকায় ছিলাম আমিসহ ১০/১২ জন। ছিলেন পাকিস্তান পুলিশ থেকে পালিয়ে আসা একজন হাবিলদার। আমাদের ভাগে ছিলো একটি টুটুবোর রাইফেলসহ ১১টি বন্দুক।

freedom-fighter

২৭ মার্চ সকালে যশোর থেকে পাক সেনারা খুলনার দিকে আসতে থাকে। খুলনায় যাতে তারা সহজে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ফুলতলাসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়। ফলে ফুলতলা থেকে খুলনা পর্যন্ত তাদের আসতে ৪/৫ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বৈকালী জংশন এলাকায় পাক সেনারা পৌঁছালে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে ১১টা বন্দুক দিয়ে পরপর ফায়ার করা হয় তাদের লক্ষ্য করে। কিন্তু প্যারামিলিটারিদের ভারি অস্ত্রের মুখে আমরা টিকতে পারিনি। এদিন আমাদের দুইজন আহত হন। পরদিন ২৮ মার্চ বয়রা পিএমজির সামনের কালভার্ট ভেঙে ফেলার চেষ্টা করি আমরা। কিন্তু তা করতে পারিনি। এদিন আমাদের একজন নিহত হন।

মোশাররফ হোসেন বলেন, সম্মুখ যুদ্ধের পর পাক সেনারা চলে আসে তাদের ঘাঁটিতে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালাতে থাকে। আমার পরিবারের সদস্য শেখ আবদুল করিম, শেখ আব্দুল ওয়াদুদ, শেখ হাসান সরওয়ার, শেখ আবু জাফর, শেখ দেলোয়ার হোসেন, শেখ হাসান আকতার বুলু, ইসহাক আহমেদ, শেখ সাহজাহান, শেখ হাসান আমীর ও আমি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই। আমার বয়স কম থাকায় অন্যরা আমাকে বাড়িতে রেখে ভারতে চলে যান প্রশিক্ষণ নিতে। পরে তারা ফিরে এসে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন। ২৮ মার্চ রাতের আঁধারে বয়রা এলাকার অনেকেই পালিয়ে যান ভৈরব নদ পার হয়ে দেয়াড়া, রাজাপুর ও বেলফুলিয়া এলাকায় আশ্রয় নেয়ার জন্য। কিন্তু সেসব এলাকায় আগে থেকেই হাজার হাজার শরণার্থী আশ্রয় নেন।

সে সময় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া, থাকার ব্যবস্থা করা, যাতায়াত সবই করেছি। গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোনো বাহনই তখন ছিল না। ফলে সেই গাড়ির ব্যবস্থা করে তাদেরকে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। অধিকাংশ লোক সাতক্ষীরা হয়ে ভারতে চলে যান। বয়রা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খবরা খবর নগরীর কেডিঘোষ রোড এলাকায় অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দেয়ার কাজ করেছি বহুবার। একবার ধরাও পড়েছিলাম। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কল্যাণে সে যাত্রায় ছাড়া পাই।

মোশাররফ হোসেন আরও বলেন, কিছুদিন পর আমরা আবারো খুলনায় চলে আসি। কিন্তু তার আগেই লুটপাট হয়ে যায় আমাদের বাড়িঘর দোকানপাট। তারপরও আমার মা দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাইয়েছেন। তাদেরকে চাল ডাল দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আমাদের বাড়ির ১১ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও কেউ কোনো সময় সনদপত্রের জন্য চেষ্টা করিনি।

তিনি বলেন, আমি ৯৬ সালে একবার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সনদপত্র পাইনি। তারপর আর চেষ্টাও করিনি। সনদের দরকার এখন আর নেই বলেও জানান তিনি।

দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বর্তমানে ভালোই কাটছে ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেনের। যুদ্ধের পর ঋণ নিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। একমাত্র মেয়ে আনিকা বুশরা বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বড় ছেলে শেখ আব্দুল্লাহ মেজবাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। আর ছোট ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে মাদ্রাসায়।

এমজেড/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।