শিগগির বাংলাদেশে ‘কোভ্যাক্সিন’র ট্রায়াল চালাতে চায় ভারত
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজস্ব উৎপাদিত টিকার খ্যাতি বাড়াতে বাংলাদেশে ‘কোভ্যাক্সিন’ ট্রায়ালের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে ভারত। ইতোমধ্যে এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের অনুমোদনও দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। সোমবার (২ আগস্ট) ভারত সরকারের একটি অভ্যন্তরীণ নথির বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস।
ওই নথিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ‘কোভ্যাক্সিন’র ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল নিশ্চিত করেছে ভারত সরকার। ভারত বিভিন্ন দেশে তাদের মিশনগুলোর সাহায্যে স্থানীয় নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষগুলোর দ্বারস্থ হয়ে কোভ্যাক্সিন ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য জোরপ্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এতে বলা হয়েছে, বিদেশে, বিশেষ করে প্রতিবেশী অঞ্চলে ‘কোভ্যাক্সিন’র সম্মান বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশে এর ট্রায়াল পরিচালনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের জৈবপ্রযুক্তি বিভাগ এবং ভারত বায়োটেকের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি দলের ঢাকা সফরের ব্যবস্থা করেছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া বাংলাদেশে কোভ্যাক্সিন ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলেরও অনুমোদন নিশ্চিত করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এখন বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলেই ট্রায়াল শুরু হতে পারে।
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, বাংলাদেশের মেডিক্যাল গবেষণা কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, ‘কোভ্যাক্সিন’ ট্রায়ালের জন্য আবেদন করেছে ভারত বায়োটেক। এ বিষয়ে অবগত কয়েকজনের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি আরও দাবি করেছে, গত ১৮ জুলাই দেশে ‘কোভ্যাক্সিন’ ট্রায়াল পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল গবেষণা কাউন্সিল (বিএমআরসি)। আর এতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেছেন বিএমআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত মাসে এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। থার্ড ফেজের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। থার্ড ফেজ হলো ইতোমধ্যেই এ টিকা মানবদেহে সফলতার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সংখ্যা যত বেশি বাড়ানো যায় তত প্রতিষ্ঠানের সুনাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাড়ে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে।’
মানুষের ওপর দেশে যে কোনো ধরনের প্রতিষেধকের ট্রায়ালের অনুমোদনের কর্তৃপক্ষ হলো বিএমআরসি উল্লেখ করে মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাগজপত্র জমা দিয়েছে, যার পর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেয়া হয়।’
কবে থেকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘বিএমআরসি চূড়ান্ত অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এখন টিকা কী প্রক্রিয়ায় আনা হবে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য কত ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেয়া হবে ইত্যাদি প্রস্তুতি সাপেক্ষে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে নথিপত্র উপস্থাপন করবে। অধিদফতরের অনুমোদন পাওয়ার পর তারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাবে।’
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত ভ্যাকসিন সাপ্লাই ওয়েবসাইটের হিসাব বলছে, দেশটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে মোট এক কোটি তিন লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ লাখ উপহারের এবং বাকি ৭০ লাখ বাংলাদেশের কেনা। তবে এর মধ্যে কোনো কোভ্যাক্সিন নেই, পুরো চালানই অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, যা সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত।
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল এই টিকার বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সিনোফার্মের টিকার ৩০ কোটি ডোজ কিনতে চীনের সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং রাশিয়া থেকেও কয়েক লাখ স্পুটনিক ভি টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট চুক্তি মোতাবেক তিন কোটি ডোজ টিকা না দেয়াতেও মনোক্ষুণ্ন হয়েছে বাংলাদেশ। গত নভেম্বরে সই হওয়া চুক্তি অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে কোভিশিল্ড দেয়ার কথা ছিল ভারতীয় ওষুধনির্মাতা সংস্থাটির। কিন্তু করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে গত এপ্রিলে টিকা রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। সেই নিষেধাজ্ঞা আজও তুলে নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশে কোভ্যাক্সিন ট্রায়ালের বিষয়ে জানতে এর নির্মাতা ভারত বায়োটেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল হিন্দুস্তান টাইমস কর্তৃপক্ষ। তবে এতে সাড়া পাওয়া যায়নি। ভারতীয় মেডিক্যাল গবেষণা কাউন্সিলের (আইসিএমআর) সঙ্গে যৌথভাবে এই টিকা তৈরি করেছে ভারত বায়োটেক।
করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে কোভিশিল্ডের পাশাপাশি জনগণকে কোভ্যাক্সিনও দিচ্ছে ভারত সরকার। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রযুক্তিতে তৈরি কোভিশিল্ড নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য না হলেও দেশটিতে কোভ্যাক্সিনের ব্যবহার নিয়ে রয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে এটি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। তাছাড়া, জরুরি ব্যবহারে এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন পায়নি ভারতীয় টিকাটি।
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি মাসের শুরুর দিকে কোভ্যাক্সিন সংক্রান্ত চূড়ান্ত বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে ভারত বায়োটেক। এতে বলা হয়েছে, উপসর্গযুক্ত সংক্রমণ রোধে ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ কার্যকর কোভ্যাক্সিন। ব্রাজিল, ভারত, ফিলিপাইন, ইরানসহ বিশ্বের ১৬টি দেশ এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। আরও ৫০টি দেশে অনুমোদনপ্রাপ্তি প্রক্রিয়াধীন। আর জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য ডব্লিউএইচও’র সঙ্গে যোগাযোগ করছে ভারত বায়োটেক।
তবে সম্প্রতি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভারত বায়োটেকের চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। একটি ব্রাজিলের, অন্যটি দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারত বায়োটেক উদ্ভাবিত করোনা টিকার দুই কোটি ডোজ কিনতে ১৬০ কোটি রিয়ালের (ব্রাজিলিয়ান মুদ্রা) চুক্তি করেছিল ব্রাজিল। কিন্তু সেখানে অতিরিক্ত মূল্য, শুল্কছাড়সহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তিটি স্থগিত করে ব্রাজিল সরকার। তাছাড়া, গত সপ্তাহে কোভ্যাক্সিনকে জরুরি ব্যবহারে অনুমোদন সংক্রান্ত একটি আবেদনও বাতিল করে দিয়েছে ব্রাজিলিয়ান কর্তৃপক্ষ।
কেএএ/এমইউ/এইচএ/জেআইএম