অভ্যস্ত হও, নয় চোখ বন্ধ করো
নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র তাসীনুর রহমান সাফি। প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্রের স্কুল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বেতন না নেয়া এবং বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনিশ্চয়তার একটি ঘটনা ‘স্থানীয় খবর’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার কথা। কিন্তু খবরটি জাতীয় খবরে পরিণত হয়েছে, কারণ ছাত্রটি প্রথম শ্রেণির। ছোট্ট একটি ছেলে বা শিশু এ খবরের উপাদান হওয়ায় খবরটির সংবেদনশীলতার মাত্রা অনেক বেশি। শিশু সব হিসেবের বাইরে। তাবৎ দুনিয়ার অবস্থান শিশুর পক্ষে। শিশুর বিপক্ষে কেউ নেই, থাকেও না। এ অভিমতের বিপরীতে কেউ হয়তো বলতে পারেন, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যুদ্ধে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত বা সম্প্রদায়গত দাঙ্গায় নিরীহ অনেক শিশু কী মারা যায় না? সহজ উত্তর অনেক নিরপরাধ ও নিরীহ শিশু মারা যায়, তবে এটা নিশ্চিত যে, ওই হামলা বা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নিশ্চয় শিশু না। ঘটনা চক্রে এ ধরনের ঘটনায় শিশুরা শিকার হয় মাত্র। নারায়ণগঞ্জের স্কুলছাত্র সাফির ঘটনাটি একেবারে ভিন্ন। প্রথম শ্রেণির ছাত্র ছোট্ট শিশু সাফির ওপর একদল মনুষ্য জাতির সংঘবদ্ধ দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে। এ দৃষ্টি অশুভ।
ওই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে কয়েকজন ছাত্রের অভিভাবক জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অভিযোগ করেছেন। স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি এ অভিযোগ করার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির ছাত্র সাফির বাবার সম্পৃক্ততা আছে মনে করে প্রতিশোধ হিসেবে সাফির ওপর মানসিক নিপীড়ন শুরু করছে। এটা সরাসরি দুর্বৃত্তপনা। প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্র এই দুর্বৃত্তপনার শিকার হতে পারে না। সকলের কাছ থেকে স্নেহভরা আচরণ শিশুর প্রাপ্য। এই প্রাপ্যতা শিশুর অধিকার; দয়া বা অনুকম্পা নয়। স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি শিশু সাফির প্রতি যে আচরণ করেছে, সেটা অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু কে এই অন্যায়ের প্রতিকার করবে? ন্যায়-অন্যায়ের প্রতিকার আজকাল উপেক্ষিত। এসব কথা অনেকটা আদর্শিক কথাবার্তায় রূপ নিয়েছে। এখন আদর্শিক কথাবার্তা শুধু চিন্তা, চেতনায় সীমিত রাখতে হয়, বাস্তবে, প্রয়োগে নয়। আমাদের এ ধারণা অমূলক হবে না যে, শিশু সাফির প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিকার তো হবেই না, উল্টো আসছে নতুন শিক্ষাবর্ষে শিশু সাফিকে ওই স্কুল ছাড়তে হবে। গণমাধ্যম ও প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারি এবং জবাবদিহিতার ভয়ে হয়তো স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি সাফিকে স্কুল ত্যাগের ছাড়পত্র দিবে না। কিন্তু এ কথা সহজবোধ্য যে, ওই স্কুলের আঙ্গিনাটি শিশু সাফির জন্য বিষময় করে তোলা হয়েছে। হয়তো প্রাণে ভরপুর পরিবেশের খোঁজে সাফির বাবা নিজেই তার সন্তানের জন্য অন্য স্কুল বেছে নেবেন।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী অভিভাবকদের নামের মধ্যে সাফির বাবার নাম নেই। এরপরও অভিযোগকারীদের মধ্যে সাফির বাবা রয়েছেন, এমন ধারণার ওপর নির্ভর করে ব্যবস্থাপনা কমিটি সাফির বাবাকে শায়েস্তা করার জন্য তাদের হাতের মুঠোয় থাকা সাফিকে বেছে নিয়েছে। আর অভিযোগপত্রে সাফির বাবা স্বাক্ষর করলেই বা এমন কী দোষের ছিলো? স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি অভিযোগ খণ্ডন করবে, সেটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কমিটি সে পথে না গিয়ে প্রতিশোধ হিসেবে শিশু সাফিকে বেছে নেয়া, লোকগুলোর কুৎসিত মানসিকতা উন্মোচিত হয়েছে। সরকারি প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শিশু সাফির বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাখলেও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা সাফির বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম শ্রেণির একটি শিশুর খাতা মূল্যায়নের বিদ্যার বাহাদুরি প্রকাশ, এক প্রকার মানসিক অসুস্থ্যতার লক্ষণ। প্রকাশিত রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে এডহক কমিটি গঠন করতে চেয়েছিলো। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্যের বাধারমুখে তা করতে পারেনি।
ওই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বৃত্তপনা দেশের একটি খণ্ডচিত্র বলা যায়। দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই দুর্বৃত্তপনা কম-বেশি ঘটছেই। এর কারণও জানা। বাংলাদেশে যেটা যেভাবে চলছে, চলুক- এ সংস্কৃতি গেঁড়ে বসেছে। নিগ্রহের শিকার ব্যক্তি নিগৃহীত হবে, বঞ্চিত ব্যক্তি বঞ্চিত হতে থাকবে, এটা স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে। প্রতিরোধের যেন কেউ নেই। ব্যাপারটা যেনো পারলে এ অবস্থায় অভ্যস্ত হও, নয়তো চোখ বন্ধ করে থাকো।
এ কথা সকলের জানা যে, চূড়ান্ত অবনতির পর, ঘটনা ইতিবাচকের দিকে রূপান্তর ঘটে। মনে হয়, স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বৃত্তপনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ কারণে, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বেসকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে পিএসসির আদলে পৃথক বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন (এনটিএসসি) গঠন করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটা এই ইতিবাচক পরিবর্তনেরই লক্ষণ। এরফলে ব্যবস্থাপনা কমিটির নিয়োগ বাণিজ্য ও অন্যান্য দুর্বৃত্তপনা কমে আসবে। আমরা মনে করি সরকারের এ শুভ উদ্যোগটির বাস্তবায়ন ঘটলে, স্কুল ও কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির অশুভ শক্তিটি বিতাড়িত হবে।
লেখক: গবেষক
[email protected]
এইচআর/পিআর